ভাসানচরে রোহিঙ্গা : পাঁচ কূটনীতিকের ‘শঙ্কা’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী/ ছবি: সংগৃহীত
রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পাঁচ বিদেশি কূটনীতিক। বৈঠকে তারা কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে ‘শঙ্কা’ প্রকাশ করেছেন।
বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও কানাডার পাঁচ কূটনীতিক বৈঠকে অংশ নেন।
বিজ্ঞাপন
বৈঠকের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের বিষয়ে তারা (কূটনীতিক) কিছুটা চিন্তিত বলে মনে হয়েছে। আমরা বলেছি, ভাসানচরে কাউকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছি না।’
মন্ত্রী বলেন, ‘এই পাঁচ দেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা করতে চায় বলেও জানিয়েছে। আমরা বলেছি, ভাসানচরে ১৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ দিয়েছি, সাইক্লোন শেল্টার, রাস্তাঘাট করে দিয়েছি। যে কেউ ইচ্ছা করলে যেতে পারবে। আমি তাদের ভাসানচরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছি। বলেছি, আপনারা ঘুরে দেখে এলে আর শঙ্কা থাকবে না।’
বিজ্ঞাপন
২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।
এদিকে, ১৪ ডিসেম্বর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ব্যবস্থাপনা ও প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি করেছে সরকার। ১৭ সদস্যের এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। কমিটির প্রধান হিসেবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন এই পাঁচ কূটনীতিক।
গত ৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, জননিরাপত্তা সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গারা কী অবস্থায় আছে এবং কীভাবে তারা যাবে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সভা শেষে এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।’
ভাসানচরে গেল রোহিঙ্গাদের চারটি দল
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে সরকার। সেখানে এ পর্যন্ত চার দফায় মোট ছয় হাজার ৬৭০ রোহিঙ্গাকে নেওয়া হয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের সবাই স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছিল বলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। প্রথম দফায় গত ৪ ডিসেম্বর এক হাজার ৬৪২ জন, ২৯ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় এক হাজার ৮০৪, তৃতীয় দফায় ২৯ জানুয়ারি এক হাজার ৭৭৮ এবং ৩০ জানুয়ারি চতুর্থ দফায় এক হাজার ৪৪৬ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। সেখানে পর্যায়ক্রমে এক লাখ রোহিঙ্গাকে পাঠানো হবে।
আগে থেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর বলে আসছিল, বর্ষা, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসানচর এলাকা ডুবে যেতে পারে। সে কারণে দ্বীপটি বসবাসের অনুপযোগী বলে তাদের ধারণা। একইসঙ্গে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জোর করে পাঠানো হচ্ছে বলেও দাবি করে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশেষ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এমনটাই দাবি করা হয়েছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে দ্বীপটির কোনো ক্ষতি হয়নি। দ্বীপটি ৩০ বছরের পুরনো। সেখানে আগে থেকেই মানুষজন ছিল। দ্বীপটি পুরোপুরি নিরাপদ। স্থানান্তরিত রোহিঙ্গারাও নিরাপদে থাকবেন। এছাড়া কোনো রোহিঙ্গাকে জোর করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে না।
প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি টাকায় নির্মিত রোহিঙ্গাদের জন্য এই আবাসন প্রকল্পে এক লাখ এক হাজার ৩৬০ জন শরণার্থী বসবাস করতে পারবেন। সেখানে ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি। প্রতিটি ঘরে প্রতি পরিবারের চারজন করে মোট ১৬টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজের এক প্রান্তে বসবাসকারী পরিবারের নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা গোসলখানা ও শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অন্য প্রান্তে রান্নাঘরও রয়েছে। রয়েছে বিদেশি প্রতিনিধিদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার বৈঠক
গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আজ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসার বিষয়ে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়। তবে এই বৈঠকটি হচ্ছে কি না- এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো বার্তা দিতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
বৈঠকের বিষয়ে বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এখনও এটা জানি না। আমাদের অফিসিয়াল (কর্মকর্তা) যারা আছেন তারা এটা নিয়ে কাজ করছেন। বৈঠকটি আগামীকাল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে কন্টাক্ট (যোগাযোগ) করা যাচ্ছে না। কারণ ওরা (মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ) সব লাইন অফ করে দিয়েছে।’
তবে এ বৈঠক নিয়ে ঢাকা নিযুক্ত মিয়ানমার ও চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমি সকাল বেলাও এটা নিয়ে যোগাযোগ করেছি। আমরা চাই, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকুক। প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সরকার-সরকার চুক্তি হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বিশেষে হয়নি। সুতরাং দ্য প্রসেস উইল কনটিনিউ (প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান থাকবে)।’
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান, আসবে কি আরও রোহিঙ্গা?
গত সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) অং সান সু চিসহ দলটির অন্যান্য মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারে এ সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারির ঘোষণা করা হয়।
এ অবস্থায় নতুন করে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা আবারও বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ নিতে পারে। এই অবস্থায় সরকার সীমান্তে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না- জবাবে মোমেন বলেন, ‘আমরা আমাদের বর্ডার সিকিউর (সীমান্ত নিরাপদ, যাতে আর কোনো রোহিঙ্গারা প্রবেশ না করতে পারে) করে রেখেছি। আগেরবার যারা নিপীড়িত হয়ে এসেছে তাদের আমাদের জনগণ গ্রহণ করেছে। এখন আমাদের জনগণের গ্রহণ করার মুডে আর নেই। আমরা আর নিতে রাজি নই, অন্যরা নিয়ে যাক।’
এসএইচআর/এফআর