ছবি : সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে সংগঠিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের অক্সিলারি ফোর্সগুলোর নৃশংসতাকে প্রচলিতভাবে ‘গণহত্যা’ বলা হয়। নিঃসন্দেহে এই জনপদের মানুষ ব্যাপকভাবে গণহত্যার শিকার হয়েছেন। ৩ জানুয়ারি ১৯৭২, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাভদা পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশিত ভাষ্য, বাংলাদেশের মর্নিং নিউজ পত্রিকার নিউজ এজেন্সি এনা’র বরাতে ছাপা হয় ৫ জানুয়ারি ১৯৭২। এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩০ লাখ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারও দাপ্তরিকভাবে তাই দাবি করে। যদিও কোনো কোনো পক্ষ সংখ্যাটি কম বলতে চান, যেন নিহতের সংখ্যা কম হলে নৃশংসতার দায় কমে যায়। 

তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের বিরুদ্ধে কেবল গণহত্যার অপরাধই সংগঠিত হয়নি। সাড়ে চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। দেশের ভেতরে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুকরণের শিকার হয়েছেন তিন কোটি মানুষ, আহত হয়েছেন অসংখ্য, সম্পদ লুট হয়েছে অগণিত, ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বাজার দোকানপাট ঘরবাড়ি, হিন্দু ধর্মের মানুষেরা শিকার হয়েছেন জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের।

আমাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত পাকিস্তান আর্মি ও তাদের অক্সিলারি ফোর্সগুলোর নৃশংসতাকে কেবল ‘গণহত্যা’ বলা হলে অপরাপর সব ভয়াবহ অপরাধগুলো অনুচ্চারিত রয়ে যায়। এছাড়া এই নৃশংসতার পেছনের অভিপ্রায়টিও রয়ে যায় আলোচনার বাইরে। অথচ এই অভিপ্রায় ধরতে পারা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেন, কোন উদ্দেশ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্র বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল?  

ধর্ষণেরও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল, ধর্ষণগুলো স্রেফ যৌন তাড়নায় ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের সৈনিকদের উসকে দিয়েছে। এমনকি ধর্মীয় ফতোয়াও জারি করা হয়েছিল। এসব ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল- বাঙালি জাতিসত্তার স্বকীয়তা শেষ করে দেওয়া...

ইহুদিসহ ইউরোপের নানা জাতিগোষ্ঠীর উপর জার্মানির নাৎসিদের চালানো নৃশংসতার অভিপ্রায় নিয়ে দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে কাজ করছিলেন পোলিশ আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন (Raphael Lemkin)। ১৯৩০ থেকে শুরু করা লেমকিনের প্রগাঢ় গবেষণা ও সুদৃঢ় প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে প্যারিসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত হয় ‘জেনোসাইড কনভেনশন’।

এই কনভেনশনের দ্বিতীয় ধারায় জেনোসাইডের একটা স্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলা হয়—একটা জাতি বা গোত্র, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত কার্যক্রমগুলো 'জেনোসাইড'। লক্ষণীয়, এই ধারায় 'ইনটেন্ট টু ডেস্ট্রয়' গুরুত্ব পেয়েছে। অর্থাৎ ধ্বংস করার ইচ্ছাটাও জেনোসাইড।

একটা জাতি, গোত্র, নৃতাত্ত্বিক বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে ফেলার প্রকাশ্য ঘোষণা বা ধ্বংস করার জন্য কাউকে উৎসাহিত করাও জেনোসাইড এবং জেনোসাইড একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। জেনোসাইড সংগঠিত হতে পারে যুদ্ধ কিংবা শান্তিকালীন সময়ে। যাদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড সংগঠিত হয় তারা সক্ষম হলে নিজেরা বিচারের আয়োজন করতে পারে না হলে জেনোসাইড থামানো এবং বিচার করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আইনি দায়িত্ব। 

আর্টিকেল দুই-এ জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যে 'ইনটেন্ট টু ডেস্ট্রয়' এর কথা বলা হয়েছে, আমাদের প্রেক্ষিতে এর শুরু ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ নয় বরং পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সময় থেকেই। 

১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে গুলি করে হত্যা, রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ, আরবি হরফে বাংলা লেখানোর চেষ্টা- এগুলো যেমন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ধ্বংস করার অভিপ্রায়, তেমনি অর্থনৈতিক বৈষম্যের মাধ্যমে ও বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করা চেষ্টা করা হয়েছে।

বাঙালি 'প্রকৃত মুসলমান নয়', 'দুর্বল, কালো, বেঁটে'- এ রকম চিহ্নিত করে বাঙালি জাতির প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। মূলত পাকিস্তানের শুরু থেকেই জেনোসাইডের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে এবং ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত থেকে এর চূড়ান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। 

জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণও জেনোসাইডের আরেকটি জোরালো উদাহরণ। ১৯৭১-এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা দেখি- যেসব নির্যাতনমূলক কার্যক্রমকে জেনোসাইড বলা হয়েছে অর্থাৎ হত্যা, শারীরিক ও মানসিক আঘাত, সম্পদ লুট, ধর্ষণ- এর সবকিছুই পাকিস্তানি পক্ষ কর্তৃক এখানে সংঘটিত হয়েছে।

ব্যাপক গণহত্যা এবং এক কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করার উদ্দেশ্য অবশ্যই ছিল বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। এসময় পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পীসহ সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি। এই হত্যাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শূন্য করে দেওয়া। 

ধর্ষণেরও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল, ধর্ষণগুলো স্রেফ যৌন তাড়নায় ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাদের সৈনিকদের উসকে দিয়েছে। এমনকি ধর্মীয় ফতোয়াও জারি করা হয়েছিল। এসব ধর্ষণের উদ্দেশ্য ছিল- বাঙালি জাতিসত্তার স্বকীয়তা শেষ করে দেওয়া, বাঙালি নারীর গর্ভে পাকিস্তানি সন্তান জন্ম দেওয়া- যারা অনুগত থাকবে তাদের পিতৃগোষ্ঠীর প্রতি। জাতি ধ্বংসের এই অভিপ্রায়ই জেনোসাইড। 

জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণও জেনোসাইডের আরেকটি জোরালো উদাহরণ। ১৯৭১-এর পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা দেখি- যেসব নির্যাতনমূলক কার্যক্রমকে জেনোসাইড বলা হয়েছে অর্থাৎ হত্যা, শারীরিক ও মানসিক আঘাত, সম্পদ লুট, ধর্ষণ- এর সবকিছুই পাকিস্তানি পক্ষ কর্তৃক এখানে সংঘটিত হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- এসব জেনোসাইডাল অ্যাক্ট সংঘটিত হয়েছে একটা সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আর তা হলো, বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়া।

তাই, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা আমাদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ ঘটিয়েছে তাকে কেবলই ‘গণহত্যা’ বলা মূলত একটি ভয়াবহ অপরাধকে ‘সামান্যকরণ’। গণহত্যা সামগ্রিক অপরাধের একটি উপকরণ মাত্র। বাকি অপরাধসমূহকেও আমাদের আমলে আনতে হবে এবং অতি অবশ্যই অপরাধের অভিপ্রায়টি বুঝতে হবে। 

এই বোঝা শুরু হতে পারে গণহত্যার বদলে ‘জেনোসাইড’ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে। জেনোসাইড একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই অপরাধের স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্র ও এর সহযোগীদের দ্বারা সংগঠিত জেনোসাইডের শিকার হয়েছি। কেবল দেশীয় দালাল নয় পাকিস্তান রাষ্ট্রপক্ষের বিচার এবং ক্ষতিপূরণ আদায় হতে হবে আমার চূড়ান্ত লক্ষ্য। 

হাসান মোরশেদ ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক, www.1971archive.org