ছবি : সংগৃহীত

বিষয়টি খুব অদ্ভুত। এই মানবসভ্যতার চালিকাশক্তি কিন্তু ভালোবাসা। ভালোবাসার টানে নর-নারী পরস্পরের কাছাকাছি আসে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু ভালোবাসা জিনিসটা সামষ্টিক ক্ষেত্রে খুব একটা প্রমোট করা হয় না। বরং ভালোবাসা প্রকাশকে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নোংরামি হিসেবে দেখা হয়।

বিপরীতে ঘৃণা একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ঘৃণা প্রকাশকে উৎসাহিত করতে আমরা বিভিন্ন ধারণার খোপ তৈরি করে নিয়েছি। এসব খোপে ফেলে একটা মতবাদ আমরা প্রচার করি। যারা ঘৃণা প্রকাশে উচ্চকিত তাদের ক্ষেত্রবিশেষে মহান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একটা জাতি আরেকটা জাতিকে ঘৃণা করছে, জাতীয়তাবাদের নামে। গায়ের রঙের জন্য অন্য ধরনের মানুষকে ঘৃণা করছে বর্ণবাদের নামে। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করছে ধর্মের নামে। এক চিন্তার মানুষ অন্য চিন্তার মানুষকে ঘৃণা করছে মতবাদের নামে। এমনকি এক লিঙ্গের মানুষ অন্য লিঙ্গের মানুষকে ঘৃণা করছে জেন্ডারের নামে।

আরও পড়ুন >>> ভালোবাসা কারে কয়! 

হিংসার প্রতিটি উপাদান যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, দেখব এসব দারুণভাবে বৈধতা পেয়েছে। এসব প্রমোট করার জন্য শত শত প্রতিষ্ঠান। দশ মাথার সিংহের মতো তাকিয়ে আছে দশ দিকে।

ব্যয় হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। হয়তো এতে একটি গোষ্ঠী কিছুটা লাভবান হচ্ছে, কিন্তু অশান্তি ছড়াচ্ছে সারা দুনিয়ায়। ভেবে দেখুন, জাতীয়তাবাদের ধারণা না এলে পৃথিবীতে এত যুদ্ধ বিগ্রহ হত কী?

ভালোবাসার টানে নর-নারী পরস্পরের কাছাকাছি আসে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। বংশবৃদ্ধি করে। কিন্তু ভালোবাসা জিনিসটা সামষ্টিক ক্ষেত্রে খুব একটা প্রমোট করা হয় না...

ইউক্রেন-রাশিয়ার এই যুদ্ধ কীসের জন্য। ভারত পাকিস্তানের উত্তেজনার কারণ কী? এদের সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য ভৌগোলিক ঐক্য এদের কাছে আনার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে বিপরীত। কল্পিত জাতীয়তার ধারণা এদের পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে।

পৃথিবীতে একটা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আরেকটা প্রতিবেশী দেশের সুসম্পর্ক নেই। যেন সীমানা টানা হয় ঘৃণার চাষবাসের জন্য। পৃথিবীতে অনেক দেশের আইনে আছে, সেই দেশের নাগরিক যদি অন্যদেশের নাগরিককে বিয়ে করে তাহলে তার নাগরিকত্ব চলে যায়।

আরও পড়ুন >>> সম্প্রীতি কোথায়? 

সোনিয়া গান্ধী কিংবা অং সান সুচি এই কারণে বারবার জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের শিকার হন। কী ভয়ানক ব্যাপার দেখুন, রাজনৈতিক সীমানা মানুষের মনের মধ্যে টেনে দিতে চায় রাষ্ট্র! কী স্পর্ধা! এই ঘৃণার একটা পাওয়ার ডাইনামিক্স আছে। একটা ঘৃণাকে আরেকটা ঘৃণা দিয়ে লঘু করে দেওয়া যায়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয় পরিষ্কার হবে।

আমরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কথা বলি। বলি মহাত্মা গান্ধীর আত্মত্যাগের কথা। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখুন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আন্দোলন করে যত মানুষ মারা গেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মারা গেছে তাদের রক্ষা করতে।

দুটো বিশ্বযুদ্ধে ভারতের প্রায় ১২ লক্ষ সৈনিক যুদ্ধ করে। তার মধ্যে দেড় লক্ষ মারা যায়। আরও মজার ব্যাপার, ব্রিটিশদের রক্ষা করতে যত ভারতীয় প্রাণ দিয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মারা গেছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায়। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ।

ভারতীয়দের হাতে যত ভারতীয় মারা গেছে তার ১ ভাগও ব্রিটিশের হাতে মারা যায়নি। এর জন্য দায়ী করতে পারেন ব্রিটিশদের। খুনটা কিন্তু আমরাই করেছি। কী দারুণভাবে বাইরে থেকে আসা বণিক-দস্যুরা তাদের প্রতি ঘৃণাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে নিয়ে গেছে, দেখলেন!

আরও পড়ুন >>> সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা : চেতনা জাগুক মনে 

এমনকি পরাশক্তিগুলো যখন মানবতা শান্তি ভাতৃত্বের কথা বলে, তখন কিন্তু প্রশ্ন জাগে—এর আড়ালে অন্য কোনো নতুন অভিসন্ধি নেই তো! অন্য কোনো শোষণের মন্ত্র! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র তৎপর ছিল আটলান্টিক সনদ স্বাক্ষরের জন্য।

পরে ব্রেটন উডস চুক্তি। দুটোর উদ্দেশ্যই আপাতদৃষ্টিতে মহৎ মনে হয়। মনে হবে মানব মুক্তির সনদ ছিল। এই আটলান্টিক চার্টারের কল্যাণে অবশ্য আফ্রিকা এশিয়ার অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু লাভের লাভ হলোটা কী?

আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। এশিয়ার দেশগুলোও যে খুব একটা উন্নতি করতে পেরেছে বলা যাবে না। কারণ সামন্তবাদী উপনিবেশবাদ শেষ করে শুরু হয়েছিল পুঁজিবাদী উপনিবেশবাদ। তারপর স্নায়ুযুদ্ধ। তেলের যুদ্ধ। আর কত কী?

যে টাকা মানুষ মারার পেছনে ব্যয় হয়, তা দিয়ে পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করা যেত। কিন্তু করছি না। পেছনে ঘৃণার সমীকরণ। যারা কলকাঠি নাড়াচ্ছেন, তারা দেখেছেন ভালোবাসা থেকে ঘৃণা অনেক লাভজনক।

এই কল্পিত সব ঘৃণার ধারণা নিয়ে মানবজাতি খণ্ডিত করা হয়েছে। এসবের কারণে দেশে দেশে যুদ্ধ হানাহানি অস্থিরতা। এতে কার লাভ হচ্ছে? হচ্ছে গুটিকয়েক মানুষের। সিংহভাগ মানুষই পদে পদে দলনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু সামষ্টিক প্রতিরোধ গড়ে উঠে না। এর পেছনে ঘৃণার মোহ। মানুষ ঘৃণান্ধ হয়ে আছে।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন 

২০২১ সালে পৃথিবীর সামরিক বাজেট ছিল ২১ হাজার কোটি ডলার। ২০২১ সালে পৃথিবীতে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ১০০ কোটির মতো। যাদের দৈনিক আয় ১ ডলারের কম। মানে বছরে ৩৬৫ ডলারের কম। এই ২১ হাজার কোটি টাকা এই মানুষগুলোর কাজে লাগালে অর্ধেক মানুষকে কিন্তু খালি পেটে রাতে শুতে যেতে হত না।

এদের বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারত। যে টাকা মানুষ মারার পেছনে ব্যয় হয়, তা দিয়ে পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করা যেত। কিন্তু করছি না। পেছনে ঘৃণার সমীকরণ। যারা কলকাঠি নাড়াচ্ছেন, তারা দেখেছেন ভালোবাসা থেকে ঘৃণা অনেক লাভজনক। ঘৃণা তাদের পুঁজির পাহাড়কে আরও উঁচু করে।

আজ ভালোবাসার দিনে এসব কঠিন কঠিন কথা বলা হয়তো ঠিক হলো না। কিন্তু পৃথিবীতে দিন দিন যেভাবে ঘৃণার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে এসব কথা না বলা একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা।

এই ধরিত্রীকে দীর্ঘায়ু দিতে হলে ভালোবাসার পেছনে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিশুদের ভেতরে কোনো ভাবে কোনো ফরম্যাটেই ঘৃণা প্রবেশ করানো যাবে না। এতদিন আমরা নৈতিক শিক্ষা দিয়ে এসেছি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন এসবের ভেতরে আমরা অনেক ঘৃণা প্রবেশ করিয়েছি অজান্তে। তাই খুব যত্নশীল হতে হবে শিক্ষার প্রতি।

আরও পড়ুন >>> তারুণ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম

এতদিন ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর কথা বলা হতো। এখন এর সঙ্গে ক্রিটিক্যাল কনশাসের কথাও বলা হয়। যেন অবচেতনে আমরা ঘৃণা ও হিংসাকে প্রশ্রয় না দেই।

উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যে ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস পেয়ে আসছি, তা যেন বিনা প্রশ্নে গ্রহণ না করি। মনের কষ্টি পাথরে যেটা খাদ মনে হবে, সেটা যেন এড়িয়ে যাওয়ার শক্তি থাকে বুকে। ঘৃণার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে এখন ভালোবাসাটা খুব জরুরি।

আসুন ভালোবাসার চর্চায় ব্রত হই। ভালোবাসি এই পৃথিবীকে। এই মহাবিশ্বের সব সৃষ্টিকে।

জয়দীপ দে ।। কথাসাহিত্যিক