ছবি : সংগৃহীত

৪ এপ্রিল ২০২৩ বঙ্গবাজারে এবং ১৫ এপ্রিল ২০২৩ নিউ সুপার মার্কেটে স্মরণকালের দুটি ভয়াবহ আগুন দুর্ঘটনা দেখল দেশের মানুষ। জীবনের সব হারিয়ে পথে বসেছেন এই দুটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। ভয়ানক সেই দুর্ঘটনার দগদগে ক্ষত সঙ্গে নিয়ে ঈদ উদযাপনে যায় নগরবাসী এবং দেশের সব মানুষ।

ঈদের ছুটিতে বরাবরের মতোই নীরব শুনশান হয়ে যায় কথিত তিলোত্তমা নগরী ঢাকা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নানা স্মারক বুকে ধারণ করা রাজধানী ঢাকা নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। এই গর্বের যৌক্তিক কারণ আছে অবশ্যই। কিন্তু বুড়িগঙ্গা তীরের এই নগরকে কি আমরা বাসযোগ্য রেখেছি? বা রাখতে পেরেছি? ঢাকা এখন প্রায় বিবেচনাতেই মরণ নগরী। মানুষের লোভ, অপরিণামদর্শী চিন্তা, সর্বগ্রাসী মনোভাব ইত্যাদি নানা অনুষঙ্গ মিলে এই নগর পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।

ঈদের ছুটিতে নগরবাসী দেখল শহরের প্রায় সব জায়গাতেই গ্যাসের তীব্র গন্ধ। মানুষের মনে ভর করল ভীতি আর আতঙ্ক। তীব্র ভয়ে নগরের মানুষ নেমে এলো রাস্তায়। মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো গ্যাসের চুলা না জ্বালানোর জন্য।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবাজারে আগুন : দোকান নয়, পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন

ফায়ার সার্ভিস শহরজুড়ে ঘোষণা করল অগ্নি সতর্কতা। কেন ঘটল এমনটা? রাজধানীতে তিতাসের গ্যাস লাইন থেকে ছিদ্র দিয়ে গ্যাস বের হচ্ছিল। আর সেই গ্যাস এবং তার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে তৈরি হয় এই আতঙ্ক।

তো, গ্যাস কেন হঠাৎ পাইপ লাইন থেকে বাতাসে ছড়াল? কারণ ঈদের ছুটির কারণে রাজধানী এবং আশপাশের সব কলকারখানা বন্ধ। আবাসিকেও অন্য সময়ের তুলনায় গ্যাস কম পোড়ানো হচ্ছিল, যেহেতু বেশিরভাগ নগরবাসী ঈদ করতে গ্রামের বাড়ি বা অন্য কোথাও গিয়েছেন আর এই সুযোগে উপচে পড়েছে নগরীর গ্যাসের লাইন।

ফলশ্রুতিতে মানুষের মনে তৈরি হয় চরম আতঙ্ক। দেখা দেয় দুর্ঘটনার শঙ্কা। আচ্ছা, তিতাস কি জানতো না ঈদের ছুটির সময় গ্যাস ব্যবহার কম হবে? তারা কি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারতো না? থাক, এসব প্রশ্ন করে লাভ নেই। এইদেশে কর্তৃপক্ষ প্রশ্নের উত্তর দিতে পছন্দ করেন না। উত্তর দেন না।

২০০৫ সালের পর ঢাকার গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তিত হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার ১৮ বছর পরেও একই লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস।

২৬ এপ্রিল ২০২৩, প্রতিদিনের বাংলাদেশ পত্রিকার খবর বলছে, ঢাকায় গ্যাস পাইপলাইন বিস্তৃত হয় ১৯৭৫ সালের পর। সাধারণত পাইপলাইনের মেয়াদ ধরা হয় ৩০ বছর। সেই হিসাবে ২০০৫ সালের পর ঢাকার গ্যাস পাইপলাইন পরিবর্তিত হওয়ার কথা। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার ১৮ বছর পরেও একই লাইন দিয়ে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস।

আরও পড়ুন >>> শহর যেন মৃত্যুফাঁদ 

যার ফলে পুরো রাজধানীই রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। তো, পাইপলাইন পরিবর্তন হয় না কেন? বাজেট না থাকার অজুহাত দিচ্ছে তিতাস। এটা কি কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়? আমার কাছে অন্তত না।

একটু আগে বলছিলাম না, আমাদের কর্তারা কেউ প্রশ্নের উত্তর দেন না? দিলেও তারা যা বলেন, তা শুধু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ায়। ২৬ এপ্রিল সময় টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখলাম—তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলছেন, ফুটো পাইপলাইন দিয়ে ছড়িয়ে পড়া গ্যাসে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো না। এমনিতেই হয়তো ছোটখাটো আগুন লাগতো। আচ্ছা, তার এই কথার ব্যাখ্যা কী হতে পারে?

সবাই মিলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই নগরকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছি। বসবাসের অযোগ্যই শুধু করিনি, শহরকে মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে ফেলেছি।

ধরুন, গ্যাস লিকেজ থেকে আপনার কিংবা আমার বাসায় আগুন লেগে গেল। এই ছুটিতে যারা ঢাকায় ছিলেন, সেই হাতেগোনা কয়েকজনের একজন হয়তো আপনি কিংবা আমি। এখন আপনার আমার বাসায় আগুন লেগে সব পুড়ে গেল। অথবা আপনি আমি বাসায় ছিলাম না হয়তো।

আরও পড়ুন >>> এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ!

আগুনে আমাদের শারীরিক কোনো ক্ষতি হলো না। কিন্তু বাসার নানা জিনিসপত্র পুড়ে গেল। এখন এটা যেহেতু একটা পরিবার বা কয়েকটা পরিবারের ক্ষতি, সুতরাং তিতাস এমডির ভাষায় এটা তেমন বড় ক্ষতি না? তিনি কি তাই বুঝাতে চাইলেন?

এই যদি হয় আমাদের কর্তা ব্যক্তিদের নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং জীবন সম্পর্কে মন্তব্য তাহলে আর কী বলার থাকতে পারে? কেন বছরের পর বছর খাজনা দিয়ে এইসব আমলাতন্ত্রকে পোষেন নাগরিকরা? এই প্রশ্ন কি করা যাবে? করে কি আদৌ কোনো লাভ আছে?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেন ঝুঁকিপূর্ণ নয়টি মার্কেট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই মার্কেটগুলো ভেঙে ফেলার আগে, এসবের সঙ্গে যে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য জড়িত, জীবন ও জীবিকা জড়িত সেটিও যেন বিবেচনায় নেওয়া হয় তার জোর দাবি জানাচ্ছি। এবং জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ভেঙে নতুন মার্কেট তৈরি হলে সেখানে যেন, এখনকার দোকান মালিক এবং ব্যবসায়ীরা অগ্রাধিকার পান সেটিও বিবেচনায় রাখার অনুরোধ করছি।

এবারের ঈদের ছুটিতে ঢাকার বায়ু দূষণ গেল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। বৃষ্টি না হওয়া অত্যধিক গরমসহ নানা কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে গণমাধ্যমের রিপোর্টগুলোয়। কিন্তু আসল কথা হলো—সবাই মিলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই নগরকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছি।

আরও পড়ুন >>> যেটা দিতে পারব না, সেটা কেড়ে নেওয়ারও অধিকার নেই 

বসবাসের অযোগ্যই শুধু করিনি, শহরকে মৃত্যুফাঁদ বানিয়ে ফেলেছি। এই ফাঁদ আমাদেরই ভাঙতে হবে। সময় অনেক চলে গেছে। যাচ্ছে। যাবে আরও। তবু এখনো উদ্যোগ নিলে বাঁচার উপায় আছে।

যদি এখনো আমরা নিশ্চল, নিথর বসে থাকি, তাহলে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেট, মগবাজার কিংবা আরও অনেক দুর্ঘটনার মতো একটার পর একটা কাণ্ড ঘটতেই থাকবে। সুতরাং এখনই সময় সচেতন হওয়ার। কার্যকরভাবে সচেতন হওয়ার।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টিভি