ব্লু ইকোনমি : অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সম্ভাবনা
সাগর ও মহাসাগর—প্রবাল দ্বীপ ও ডলফিন, তিমি মাছ আর মুক্তো ভরা ঝিনুক, জাহাজ ও জলদস্যুদের গা ছমছমে যত গল্প এই সবকিছুই মানুষের মাঝে এক ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি করে। সমুদ্র চিরদিনই মানুষের কাছে অপার রহস্যে ভরা।
সাগর-মহাসাগরের তলায় রয়েছে এক আশ্চর্য জগৎ। এই আশ্চর্য জগতের বিশাল জলরাশি ও বিস্তর সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে যা ‘ব্লু ইকোনমি’ নামে পরিচিত।
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ব্লু ইকোনমি হলো সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত জীবিকা সংস্থান ও কাজের লক্ষ্যে সামুদ্রিক পরিবেশের উন্নয়ন। ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম অধ্যাপক গুন্টার পাওলি ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে ধারণা দেন।
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্লু ইকোনমি ক্রমান্বয়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর এক বিশাল পরিমাণ অংশ মানব সম্পদে রূপান্তরিত করা যাবে ব্লু-কনমির মাধ্যমে। ইতিমধ্যে সামুদ্রিক সম্পদ কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির বিকাশের জন্য ২৬টি কার্যক্রম চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার।
আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?
উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন ব্লু ইকোনমিক প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে। বছর ব্যাপী গোটা পৃথিবীতে সমুদ্রকে ঘিরে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।
গোটা বিশ্বের মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান আসে সামুদ্রিক মাছ উদ্ভিদ ও জীবজন্তু থেকে। বর্তমানে পৃথিবীর মোট তেল ও গ্যাসের চাহিদার ৩০ ভাগ আসে সমুদ্র তলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যমতে, মহাসাগর ইতিমধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে প্রায় ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের মৎস্য খাত রয়েছে, ৭ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সমর্থন করে এবং দেশের প্রাণী-ভিত্তিক প্রোটিনের চাহিদার ৫০ শতাংশেরও বেশি সরবরাহ করে।
সম্প্রতিকালে দেশটি নতুন নতুন এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা বাস্তবায়িত হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশ গুণ হবে।
অস্ট্রেলিয়া সামুদ্রিক শিল্পগুলো থেকে ২০১৩-১৪ সালে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় করে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারে।
আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?
১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত মিয়ানমারের সাথে বিরোধ। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দা ল অফ সি (International Tribunal for the Law of the Sea-ITLOS) এর রায়ে ২০১১ সালে মিয়ানমারের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় এবং আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশ নতুন প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের মোট সমুদ্র সীমা ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রসীমা জয়ের পর বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের এক অপার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমুদ্র থেকে আহরিত মাছগুলোর মধ্যে ইলিশ সবচেয়ে বিখ্যাত।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে ইলিশের বিপুল চাহিদা ফলে ইলিশ রপ্তানি করে অর্জিত হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এক হিসাবে দেখা গিয়েছে বাংলাদেশে আহরিত মাছগুলোর মধ্যে ১৬ শতাংশই ইলিশ।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি করে ৩,৭৬৮ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। সবচেয়ে সমৃদ্ধ সমুদ্রসীমা হিসেবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমাকে বলা হয় সোনালী ক্ষেত্র।
২০১৫-১৬ সালে বাংলাদেশে স্বাদু পানি থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৫১ হাজার টন, অপরদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ২৬ হাজার টন। তা থেকে স্পষ্ট হয় সামুদ্রিক মাছ আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
আরও পড়ুন : বিশ্ব পরিবেশ দিবস : আমাদের ব্যর্থতা ও করণীয়
ধারণা করা হয় বাংলাদেশের সাগর সীমার মধ্যে রয়েছে তেল ও গ্যাসের খনি। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে তেল ও গ্যাস উত্তোলনের কোনো সাশ্রয়ী পদ্ধতি এখনো বাংলাদেশ বের করতে পারেনি। যথেষ্ট সামুদ্রিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি কিছুটা মন্থর।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে দেখা গিয়েছে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্র বা নীল অর্থনীতির অবদান ৬.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রায় সমান। আয়ের মূল অংশ আসে পর্যটন ও বিনোদন খাত থেকে যার পরিমাণ ২৫ শতাংশ।
মাছ ধরা খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ২২ শতাংশ, যাতায়াত থেকে আয়ের পরিমাণ ২২ শতাংশ এবং গ্যাস ও তেল উত্তোলন থেকে আয়ের পরিমাণ ১৯ শতাংশ। প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি মাছ শিকারের সাথে সম্পৃক্ত এবং ৬০ লাখ বাংলাদেশি সমুদ্রের পানি থেকে লবণ তৈরি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পে জড়িত।
দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ২৬টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
এগুলো হলো—শিপিং, উপকূলীয় শিপিং, সমুদ্র বন্দর, ফেরির মাধ্যমে যাত্রী সেবা, অভ্যন্তরীণ জলপথে পরিবহন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ রিসাইক্লিং শিল্প, মৎস্য, সামুদ্রিক জলজ পণ্য, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, সমুদ্রের লবণ উৎপাদন, মহাসাগরের নবায়নযোগ্য শক্তি, ব্লু-এনার্জি, খনিজ সম্পদ (বালি, নুড়ি এবং অন্যান্য), সামুদ্রিক জেনেটিক সম্পদ, উপকূলীয় পর্যটন, বিনোদনমূলক জলজ ক্রীড়া, ইয়টিং এবং মেরিনস, ক্রুজ পর্যটন, উপকূলীয় সুরক্ষা, কৃত্রিম দ্বীপ, সবুজ উপকূলীয় বেল্ট বা ডেল্টা পরিকল্পনা, মানব সম্পদ, সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নজরদারি এবং সামুদ্রিক সমষ্টি স্থানিক পরিকল্পনা (এমএসপি)।
বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার ব্লু ইকোনমির সুবিধাগুলো বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার চেষ্টায় আছে ফলে সাম্প্রতিককালেই বাংলাদেশ সরকার ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ সেন্টার ও একটি মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছে।
আরও পড়ুন : বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ কী?
সরকার প্রযুক্তিনির্ভরতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ সম্পর্কে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে এবং সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব সংগ্রহ এবং টেকসই বাস্তবায়নের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে।
ধারণা করা যায়, সমুদ্র সম্পদ সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হলে দেশের অর্থনীতিতে মোট আয়ের অর্ধেকের বেশি জোগান আসবে সমুদ্র সম্পদ থেকেই। তথ্য উপাত্ত ও সঠিক পরিসংখ্যান প্রদানের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের এই খাতে আরও বেশি বিনিয়োগের জন্য আকৃষ্ট করতে হবে।
উপকূলীয় অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনোদন এবং মনোরম পরিবেশের ব্যবস্থা করতে পারলে এই খাত থেকে আয়ের পরিধি আরও বৃদ্ধি পাবে এবং আরও বেশি সচল হবে।
শুধুমাত্র সরকারি উদ্যোগই নয় সাথে বেসরকারি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের সম্মিলিত প্রয়াস ঘটাতে পারলেই ব্লু ইকনমি বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারবে।
তাসনিম বাশার যারিন ।। শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়