শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’
ছবি : সংগৃহীত
পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটা দেশের নাম বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, তিনদিকে স্থল, একদিকে জল, উর্বর মাটি, প্রাকৃতিক নদনদীর সমাহার, কর্মঠ মানুষ এবং মানুষের ঐক্য এবং শ্রেণি-বর্ণ নির্বিশেষ মাছে-ভাতে স্বনির্ভর দেশটি পৃথিবীর বৃহৎ ক্ষমতাশীল দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত লোভনীয় একটি স্থল ও জল বন্দর।
বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগ থেকেই বিদেশি কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের ঝড়-ঝঞ্ঝা পার হতে হতে ইতিহাস তৈরি করে এসেছে। প্রতি পদক্ষেপেই দেশ বিদেশ জুড়ে বাংলাদেশের যেকোনো সফলতার বৈধতা, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা শত্রুতামূলক আপত্তির সম্মুখীন হওয়ার বিষয়গুলো মনে হয় কেন জানি স্বাভাবিক।
বিজ্ঞাপন
স্বাধীনতা পূর্ব ভাষা আন্দোলনসহ সব গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরে স্বাধীন দেশ প্রাপ্তির লড়াই, আমাদের মুক্তির আহ্বানে বাংলাদেশ পেয়েছিল জনগণের প্রিয় নেতৃত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক শক্তির সাথে যুক্ত হয়ে এসেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন >>> তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা বাংলাদেশ?
বিজ্ঞাপন
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভূমি মাত্র মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিতে না নিতেই আবারও বিশ্বের একমাত্র অস্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখোমুখি হতে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে তার পুরো পরিবারসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ হয়েছিল অভিভাবকহীন, নেতৃত্বহীন।
অলৌকিকভাবে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তাদের কাজের জন্য জার্মানিতে থাকার কারণে পরিবারসহ বেঁচে যান। ব্রাসেলস আর জার্মানি থেকে বহু উপেক্ষা আর অপমানের পর ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর আত্মিক সহযোগিতায় রাজনৈতিক আশ্রয়ে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন।
ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রণব মুখার্জীর সাহসী ভরসায় দেশে গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন সদস্যরা বেশ কয়েকবার দিল্লিতে যাতায়াত শুরু করেন, দেশে ফিরে আসার অনুরোধ নিয়ে। শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়া একেবারেই রাজি হচ্ছিলেন না, পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সত্যিই বেদনাদায়ক
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রণব মুখার্জীর সাহসী ভরসায় দেশে গণতন্ত্র আর প্রগতিশীলতার রাজনীতি ফেরাতে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের মাটিতে পা রাখেন তিনি। সেদিন ছিল কালবৈশাখীর তাণ্ডব। সেই প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগও গতিরোধ করতে পারেনি গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষের মিছিল।
মুষলধারার বৃষ্টি-বাদলা উপেক্ষা করে তারা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন কাঙ্ক্ষিত নেতার আগমনের জন্য। বিকেল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জনসমুদ্রের জোয়ারে এসে পৌঁছান শেখ হাসিনা। তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত রাজপথ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল।
চারদিকে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগানে ভরপুর হয়েছিল বাতাসও। জনতার কণ্ঠে প্রতিশোধের স্লোগান ভেসে আসছিল জোরালো চিৎকারে ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে, শেখ হাসিনার ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই।’
আরও পড়ুন >>> ফিরে এলেন দুঃসাহসী নাবিক
দেশের লক্ষ লক্ষ জনসাধারণের সংবর্ধনায় আপ্লুত শেখ হাসিনা সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই। জীবনের ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’
শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর রক্তধারায় বাহিত আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার ও স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে সশরীরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৮ সাল, এই সাত বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি দেশের জনগণের সামনে সাধারণ হিসেবেই দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। পুরো পরিবার হারিয়ে এক শূন্যতায় তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন বাংলাদেশের মানুষকে।
সারা দেশের মানুষ তার আপন হয়ে উঠেছিল। তিনি ফিরে আসার আগে ছয় বছর স্বৈরশাসকেরা ছিল জনগণের সর্বকর্তা। সেনাশাসকের হাতে ক্ষমতা উপড়ে ফেলার অঙ্গীকারে জনগণের শাসনের দাবি নিয়ে রাজনীতির মাঠে রাতদিনের এক অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি একজন দক্ষ কর্মী হয়ে উঠেছিলেন তৃণমূলের রাজনীতিতে। দলকে আবারও ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তার শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য শত্রুসম দেশের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে করতেই তিনি ধীরে ধীরে সফল নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন।
আরও পড়ুন >>> রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
তার ত্যাগ, ধৈর্য ও সাহসী নেতৃত্বের কারণে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে অতি দ্রুত। তাকে বারবার হত্যা চেষ্টা করা হলেও তিনি গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। বৈদেশিক কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে নিত্যদিনের লড়াই শক্ত হাতেই সামলে নিচ্ছেন।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার এ রায় কার্যকর করা শেখ হাসিনাকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন নেতৃত্বের এক এবং অনন্য অবয়ব হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
শিক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, দুটি বিষয় প্রকট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। এই দুটি ক্ষেত্রে আরও গভীরে গিয়ে এবং তৃণমূলের সাথে কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে তাকে....
বিশ্ব জলবায়ু মোকাবিলা থেকে আরম্ভ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি, মানবসম্পদ উন্নয়ন হতে মেট্রোরেলের মতো স্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পদ্মাসেতুর মতো বিশ্বমানের কাজ ছাড়াও বিভিন্ন কাঠামোগত উন্নয়নে তার দৃঢ় পদচারণায় তিনি অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন, বিশ্ব দরবারে।
আগামীর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠছে অতি দ্রুত মধ্যম উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। সফলতার মাঝে কিছু শূন্যতা থাকে। শিক্ষা এবং অসাম্প্রদায়িকতা, দুটি বিষয় প্রকট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। এই দুটি ক্ষেত্রে আরও গভীরে গিয়ে এবং তৃণমূলের সাথে কাজ করার উদ্যোগ নিতে হবে তাকে। কারণ কাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে জনগণের মানসিক কাঠামোর সুস্থ উন্নতি না করতে পারলে যেকোনো সফল উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে। মানবিক মূল্যবোধের নৈতিক স্খলন প্রতিরোধের জন্য আরও জোরদার কাজ করতে হবে তাই।
আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে
ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তঋণে পাওয়া দেশে জাতির পিতা এবং তার উত্তরসূরির রক্তধারায় প্রতিদিনের ইতিহাসের অক্ষর রচিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ পদক্ষেপ, শেখ হাসিনাকে সেই সময়ে দেশে ফিরিয়ে এনে তার হাতে দেশ নেতৃত্ব তুলে দেওয়া।
একমাত্র বঙ্গবন্ধু কন্যাই বুঝতে পারেন যে কীভাবে এই ছোট দেশকে নিজ আঁচলের মায়ায় জড়িয়ে রাখতে হয়। তিনি জানেন যে সোনার বাংলার শত্রুপক্ষ হতে কীভাবে নিজ আঁচলে লুকিয়ে রক্ষা করতে হয়।
আমাদের দেশটি তার শক্ত দুটো হাত ধরে ভবিষ্যতে পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়ের দেশ হয়ে থাকবে বলে বিশ্বাস করি। প্রত্যাবর্তন নয়, আপনি সদা সাফল্যে আবর্তিত হন বাংলাদেশ জুড়ে।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা