বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা যখন কথা বলি, তখন আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সাধারণত হাসপাতালের সক্ষমতা, চিকিৎসকের ঘাটতি, ওষুধের দাম বা স্বাস্থ্যবীমার প্রসঙ্গ থাকে। অথচ শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থার একটি অত্যন্ত বুনিয়াদি ও অপরিহার্য উপাদান হলো পাবলিক টয়লেট—বছরের পর বছর ধরে নীতিনির্ধারণী আলোচনার বাইরে রয়ে গেছে।

এমনকি দ্রুত নগরায়ণের এই সময়ে শহরের মানুষের দৈনন্দিন যাতায়াত, কর্মসংস্থান, ব্যবসা–বাণিজ্য এবং জনসংখ্যার চাপ দিন দিন বেড়ে চললেও, নির্ভরযোগ্য স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রশ্নটি এখনো রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার তালিকায় নেই।

ঢাকার মতো একটি মহানগর—যেখানে প্রতিদিন কয়েক কোটি মানুষের যাতায়াত—সেখানে কার্যকর পাবলিক টয়লেট ব্যবস্থার চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কাগজে-কলমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক পাবলিক টয়লেট থাকলেও বাস্তবে এর বড় একটি অংশই বন্ধ, ভেঙে পড়া, অকার্যকর অথবা এমনভাবে লিজ দেওয়া হয় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অনেক টয়লেটে পানি নেই, আলো নেই, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই; পরিচ্ছন্নতার কোনো নিশ্চয়তা তো নেই-ই। ফলে যেসব সংখ্যা নথিতে রয়েছে, বাস্তবিক দিক থেকে সেগুলোর একটি বড় অংশ নাগরিকের জন্য অনুপস্থিতই বলা চলে।

এ সংকটের সবচেয়ে নির্মম প্রভাব পড়ে নারীদের ওপর। বাংলাদেশে নারীর শহরভিত্তিক চলাচল যত বেড়েছে, নিরাপদ ও নারী–সংবেদনশীল টয়লেট ব্যবস্থার চাহিদাও তত বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঢাকায় এমন টয়লেট খুবই কম, যেখানে একজন নারী নিশ্চিন্তে প্রবেশ করতে পারেন।

গবেষণা বলছে, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনে আক্রান্ত হন, যার অন্যতম কারণ বাইরে নিরাপদ টয়লেট না পাওয়া। নারীরা পানি পান কমিয়ে রাখেন, দীর্ঘ সময় প্রস্রাব ধরে রাখেন, যার ফলে কিডনিতে ইনফেকশন, ব্লাডার ক্ষতি, স্টোন, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি ব্যথাজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

কাগজে-কলমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে প্রায় দুই শতাধিক পাবলিক টয়লেট থাকলেও বাস্তবে এর বড় একটি অংশই বন্ধ, ভেঙে পড়া, অকার্যকর অথবা এমনভাবে লিজ দেওয়া হয় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনাও শহুরে নারীদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ অধিকাংশ পাবলিক টয়লেটে ন্যাপকিন ফেলার জায়গা নেই, নেই গোপনীয়তা ও উপযুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা। একটি শহরের টয়লেট অবকাঠামো যখন নারী–সংবেদনশীল নয়, তখন সেই শহর নারীর কাছে নিরাপদ থাকে না; তাদের চলাফেরা, কাজের সুযোগ এবং ব্যক্তিগত মর্যাদার ওপর দৃশ্যমান প্রভাব পড়ে।

এই সংকটের ভুক্তভোগী শুধু নারীরাই নন। প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় কয়েক লাখ পথশিশু, গৃহহীন মানুষ, হকার, রিকশাচালক, শ্রমজীবী মানুষ, রোগী ও তাদের স্বজনদের জীবনে টয়লেটের অভাব একটি স্থায়ী দুর্ভোগ। তাদের অনেকেরই সারাদিন শহরে থাকার পরও কোনো টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ নেই।

বাধ্য হয়েই তারা দেয়ালের ধারে, ড্রেনের পাশে বা গোপন কোনো কোণে প্রস্রাব করে। কেউ আবার খোলা স্থানে মলত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে যে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়, তা নগর জীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মানববর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশে; পানি, বায়ু এবং মাটির দূষণ বেড়ে যায় এবং জলবাহিত রোগ—ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড—দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

বিশেষ করে বর্ষাকালে ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। শিশুদের অপুষ্টি ও স্টান্টিংয়ের অন্যতম কারণও হলো মানববর্জ্য–দূষিত পরিবেশে তাদের বড় হওয়া, যা নগরের টয়লেট সংকটকে আরও বৃহৎ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরিণত করে।

এ সংকটের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুর্ভোগ আরও গভীর। অধিকাংশ পাবলিক টয়লেটেই র‍্যাম্প নেই, দরজা যথেষ্ট প্রশস্ত নয়, গ্র্যাব–বার বা উপযুক্ত হ্যান্ড সাপোর্ট নেই। তারা অনেক সময় টয়লেট ব্যবহারের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হন, যেটি নাগরিক মর্যাদার সরাসরি লঙ্ঘন।

পাবলিক টয়লেট সংকটের পেছনে কারণ একাধিক। এর মধ্যে অন্যতম হলো নীতিগত উপেক্ষা। বাংলাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো এখনো টয়লেট রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দেয় না। বাজেটে বরাদ্দ কম, তদারকি দুর্বল এবং লিজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নেই। যে স্থাপনা শহরের মানুষ প্রতিদিন ব্যবহার করবে, তার রক্ষণাবেক্ষণ যদি পরিকল্পনার কেন্দ্রেই না থাকে, তবে সেটি দ্রুত অব্যবহারযোগ্য হয়ে পড়াই স্বাভাবিক।

সামাজিক ট্যাবুও একটি বড় বাধা। টয়লেট নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা অনেকের জন্য বিব্রতকর হওয়ায়, নীতি পর্যায়েও বিষয়টি অগ্রাধিকার হারায়। অথচ স্যানিটেশন একটি স্বীকৃত মানবাধিকার—এটি সংবিধানের নাগরিক অধিকার, জনস্বাস্থ্যের মৌলিক উপাদান এবং মর্যাদার প্রশ্ন।

তবে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি রয়েছে, যা আশা জাগায়। ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, ভূমিজো এবং ব্র্যাকের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক, নিরাপদ এবং নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেটের সফল মডেল দাঁড়িয়ে আছে। এসব মডেলে প্রবেশযোগ্যতা, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা, আলোকসজ্জা, মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা, প্রতিবন্ধীবান্ধব নকশা এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় ব্র্যাকের সহযোগিতায় যেভাবে নারীবান্ধব ও নিরাপদ টয়লেটের সংস্কার হয়েছে এবং যেখানে আদালত কর্তৃপক্ষ নিজেই খরচের অর্ধেক বহন করেছে—এগুলো আমাদের জন্য শক্তিশালী উদাহরণ। শুধু তাই নয়, আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং ব্র্যাক ও ভূমিজো’র সহায়তায় ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও সংস্কার কাজ চলছে। দ্রুতই সেগুলো চালু হবে।

এ পাইলট প্রকল্প সফল হলে সরকার দেশের ৬৪টি জেলার আদালত প্রাঙ্গণে এমন টয়লেট সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রত্যাশা করছে। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় পাবলিক টয়লেট কেবল জনস্বাস্থ্যসেবা নয়, আর্থিকভাবেও টেকসই হতে পারে।

পাবলিক টয়লেট কোনো বিলাসিতা নয়; এটি জীবনের অত্যন্ত মৌলিক চাহিদা। এটি জনস্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবেশরক্ষা এবং নিরাপদ নগর জীবনের অপরিহার্য উপাদান।

বিশ্বের অনেক শহর কীভাবে টয়লেটকে নগর পরিকল্পনার কেন্দ্রে এনেছে, তা বাংলাদেশের জন্য শেখার মতো। টোকিওতে প্রায় প্রতিটি পার্ক, মেট্রোস্টেশন ও প্রধান সড়কের পাশে পাবলিক টয়লেট আছে, যেগুলোর স্থাপত্যশৈলী নিজেই একটি পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র।

সিউলে ব্যবহারকারীর মতামতের ভিত্তিতে টয়লেট রেটিং করা হয়। লন্ডনে শিশু ও জেন্ডার–নিউট্রাল টয়লেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে ‘স্মার্ট টয়লেট’ ধারণা চালু হয়েছে, যেখানে সেন্সরের মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা মনিটরিং করা হয়। এসব শহর প্রমাণ করে—টয়লেট অবকাঠামো একটি সভ্য ও মানবিক শহরের পরিচয়।

বাংলাদেশের শহরগুলোয়ও এখন সময় এসেছে একই মানদণ্ডে এগিয়ে যাওয়ার। শুধুমাত্র নতুন টয়লেট নির্মাণ করলেই হবে না; দরকার রক্ষণাবেক্ষণ, সুশাসন, পর্যবেক্ষণ এবং সামাজিক আচরণের পরিবর্তন। শহরভিত্তিক ‘স্যানিটেশন মাস্টার প্ল্যান’ তৈরি করা জরুরি, যেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে কতগুলো টয়লেট প্রয়োজন, কোথায় সেগুলো স্থাপন করা হবে এবং কে রক্ষণাবেক্ষণ করবে—এসবের স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।

বাজেটে পৃথক বরাদ্দ রাখতে হবে। লিজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রতিবন্ধী ও নারীবান্ধব নকশা বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে রিয়েল–টাইম পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা মনিটরিং করতে হবে। একই সঙ্গে টয়লেট ব্যবহারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করাও জরুরি।

পাবলিক টয়লেট কোনো বিলাসিতা নয়; এটি জীবনের অত্যন্ত মৌলিক চাহিদা। এটি জনস্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবেশরক্ষা এবং নিরাপদ নগর জীবনের অপরিহার্য উপাদান। সমাজ যদি নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং মর্যাদাপূর্ণ নগর জীবন গড়তে চায়, রাষ্ট্র যদি নারীর নিরাপত্তা ও সমতা নিশ্চিত করতে চায় এবং নগরের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চায়—তবে পাবলিক টয়লেট অবকাঠামোকে এখনই অগ্রাধিকার দিতে হবে। নগরজীবনের ভবিষ্যৎ টেকসই করতে হলে রাষ্ট্র, সিটি কর্পোরেশন, উন্নয়ন সংস্থা এবং নাগরিক—সবার যৌথ প্রয়াসই হবে পথ।

ঢাকা শহর বিশ্বমানের শহর হবে কি না—তার অন্যতম পরীক্ষা লুকিয়ে আছে শহরের প্রতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ টয়লেট নিশ্চিত করার মধ্যেই। এই জরুরি মানবিক সেবাটি যতদিন অবহেলিত থাকবে, ততদিন নগর জনস্বাস্থ্য নিরাপদ হবে না। এখনই সময় রাষ্ট্রকে জাগ্রত হওয়ার—একটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার।

সুমন্তা সায়রী শ্রেয়া : উন্নয়নকর্মী