ক্রীড়াঙ্গনে নারী হেনস্তা বন্ধে করণীয় কী?
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’—বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতার এই পঙ্ক্তি আজও শত চ্যালেঞ্জের মুখে! আজ থেকে শতবছর আগে ১৯২৫ সালে কবির ‘সাম্যবাদী’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতা আজও সাম্যের ডাক দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু লাভ কি হচ্ছে?
কালান্তরের ঘোড়ায় চেপে সময় ছুটছে, অধিকার-গৌরব-প্রাপ্তিতে নারী এগিয়েছে, কিন্তু সমতা কি এসেছে? বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ভালো-খারাপ কত কী ঘটছে, সেখানে বিচার ও হিসাবের নিক্তিতে লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য কি এখনো প্রকট নয়?
বিজ্ঞাপন
লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য মানুষের মনোজগতের এক অন্ধকার দিক, যা সে সমাজ থেকে পায়-পরিবার থেকে পায়! এটা হঠাৎ করে উধাও করে দেওয়া যায় না! আর তাই প্রাতিষ্ঠানিক জীবন ও আচরণেও এর প্রভাব থেকে যায়। যে কারণে বিশেষভাবে প্রতিভাবান হয়েও ক্রীড়াক্ষেত্রেও নারীরা অসংখ্য লঙ্ঘনের সম্মুখীন হন—আর এটি এমন না যে শুধু আমাদের দেশেই সংঘটিত হচ্ছে, অন্য কোথাও না! সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেটে ঘটে গেছে এমন কিছু ঘটনা যা প্রকাশিত হয়েছে। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে তদন্ত কমিটি করতে হয়েছে। হঠাৎ আসা এই আঘাতে বেসামাল বিসিবি, ক্ষতিগ্রস্ত হবে নারী ক্রিকেটের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মাঠের সাফল্য!
ক্রীড়াক্ষেত্রে বর্ণবাদ ও যৌন হয়রানিকে ধরা হয় সবচেয়ে কলুষিত ব্যাপার হিসেবে, এরই একটির শিকার এখন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট! ভীষণ রকম এক অভিঘাতে কেঁপে গেছে নারী ক্রিকেটের অস্তিত্ব ও এর ভিত। বাংলাদেশের যে সামাজিক ও পারিবারিক বুনিয়াদ তাতে যেকোনো অভিভাবকই এখন দ্বিধায় পড়বেন, তার সন্তানকে ক্রিকেটে দেবেন কিনা?
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে এক দশক ও তার বেশি কিছু সময়ে নারীদের ফুটবল ও ক্রিকেটে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাথলেটের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ, এখন গ্রামের মাঠেও অবাধে এই দুটি জনপ্রিয় খেলায় মেতে উঠছে কিশোরী-তরুণীরা! এ যে কত বড় সামাজিক বিপ্লব সেটি অনুধাবন করা যায় এই দুই ডিসিপ্লিনে নারীদের সাফল্য।
পুরুষ ক্রীড়াবিদদের পাশাপাশি এখন নারী ক্রীড়াবিদদের নামও অজানা নয় ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে। তারাও সামাজিক সম্মান ও তারকা খ্যাতি পাচ্ছেন। এই অর্জন কি কোনোভাবে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিচ্ছে দল-ফেডারেশন বা বোর্ডের সহকর্মীদের কাছে? তারকা খ্যাতির বিড়ম্বনা বাংলাদেশের শীর্ষ পুরুষ ক্রিকেটাররাও সেভাবে সামলাতে পারেননি তাদের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে, নারী শীর্ষ ক্রিকেটাররাও সেই চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন কিনা—সেটিও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশে এক দশক ও তার বেশি কিছু সময়ে নারীদের ফুটবল ও ক্রিকেটে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। অ্যাথলেটের সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ, এখন গ্রামের মাঠেও অবাধে এই দুটি জনপ্রিয় খেলায় মেতে উঠছে কিশোরী-তরুণীরা!
এক সময় লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল দেশের নারী ক্রিকেট। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় নারী এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা, ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা। এরপর থেকে দ্রুততার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে নারী ক্রিকেট। বোঝা যাচ্ছে যৌন হয়রানি সেখানে আলোচিত ইস্যু হলেও এটিই একমাত্র সমস্যা নয়!
অনেক নেতিবাচক চর্চা ও রাজনীতির বিষয় ছিল, যে কারণে এই বিস্ফোরণ! সবশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভালো অবস্থানে থেকেও ম্যাচ হেরেছে বাংলাদেশ। স্বাভাবিকভাবেই এর একটা প্রভাব ক্রিকেটারদের মধ্যে পড়েছে, অধিনায়কও নিশ্চয় ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন! কিন্তু প্রবাসী ও দল থেকে বাইরে থাকা এক ক্রিকেটার যেভাবে অধিনায়কের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তাতে বোঝা যাচ্ছে দলে সংহতির অভাব রয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠছে শুধু একজন ক্রিকেটার কেন পুরো সিস্টেমকে আগুনের গোলায় নিক্ষেপ করেছেন—এখানে কি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? বিসিবি নিশ্চয় এখন অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং দ্রুত উত্তপ্ত পরিস্থিতি সামলে নিতে সক্ষম হবে।
আমাদের নিশ্চয় স্পেন ও বিশ্ব ফুটবলে ‘রুবিয়ালেস ক্রাইসিস’-এর কথা মনে আছে? ২০২৩ সালে স্পেন নারী ফুটবল দল বিশ্ব-চ্যাম্পিয়ন হলে সেই ঘটনা ছাড়িয়ে উঠে আসে রুবিয়ালেসের চুমুকাণ্ড! স্পেনের ফুটবল ফেডারেশন সভাপতি নারী ফুটবলার জেনি হারমোসোর ঠোঁটে চুমু দিয়েছিলেন প্রকাশ্যে, পরে অস্বীকার করেছিলেন যৌন তাড়নার কথা, বরং বলেছিলেন আবেগতাড়িত হয়ে এই কাজ করেছিলেন—পরবর্তীতে তিনি কিন্তু পার পাননি!
আরও পড়ুন
এই ঘটনাটি এমন এক সংকটের জন্ম দেয়, যার ফলে খেলোয়াড়রা বিক্ষোভে নামে। সব কোচিং স্টাফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়, রুবিয়ালেস হন বরখাস্ত এবং শেষ পর্যন্ত পদত্যাগও করেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য প্রভাবশালী মানুষটির বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে ফৌজদারি শাস্তির ঘটনাও ঘটে।
এখন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে যেসব কর্মকর্তা ও কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা কেউ শীর্ষস্থানীয় কেউ নন, অর্থাৎ তারা তদন্তের যেকোনো পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করবেন—এরকম শঙ্কা কম। এই বিষয়টির একটা সুরাহা হওয়াও দরকার। এখন সময়ের সাথে স্তিমিত হয়ে যাবে এটা ভেবে সময় ক্ষেপণ করার নীতি, নতুন সঙ্কটের জন্ম দিতে পারে। সব প্রশ্নের সমাধান না হোক উত্তর যেন অন্তত বেরিয়ে আসে এই দফা।
ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের বিচরণ নিয়ে কিছু সংস্কার রয়েছে সমাজে। নারীদের পারফর্মেন্স পুরুষের তুলনায় দুর্বল ও একঘেয়ে বলে মত আছে বিশ্বজোড়া। একারণে মেয়েদের খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষক পাওয়া কঠিন, আর গণমাধ্যমও তাদের খেলার কাভারেজ কম করে থাকে। কিন্তু এরপরও কি থেমে আছে নারীদের অগ্রযাত্রা?
এই যেমন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বছর দুয়েক আগে নারীদের ম্যাচ ফি, পুরুষদের সমান করেছে। নিউজিল্যান্ডের নারী ক্রিকেট দলের পারফর্মেন্সও বেশ আশা জাগানিয়া। পরের বছরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছে প্রণোদনা কতটা কাজে দেয়।
পুরুষদের আগে জাপানের নারী ফুটবল দল বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেছে, দেখিয়ে দিয়েছে তাদের সামর্থ্য! ইতিহাসজুড়ে রয়েছে নারীর সমতা অর্জনের লড়াই। এ লড়াই সবক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও। ভাবতে পারেন এক সময় নারীদের অলিম্পিক গেমস দেখার অনুমতি ছিল না, খেলা তো দূরের কথা! অথচ সেই অলিম্পিকে এখন নারীদের ইভেন্ট, নারীদের ডিসিপ্লিন মানেই জমজমাট।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বছর দুয়েক আগে নারীদের ম্যাচ ফি, পুরুষদের সমান করেছে। নিউজিল্যান্ডের নারী ক্রিকেট দলের পারফর্মেন্সও বেশ আশা জাগানিয়া। পরের বছরই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তারা দেখিয়ে দিয়েছে প্রণোদনা কতটা কাজে দেয়।
১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক থেকেই যেন নতুন এক যাত্রার শুরু। তবে তারও আগে নারীদের নবযাত্রার প্রথম সোপানটি রচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭২ সালে দেশটিতে এমন এক আইন পাস হয়, যেখানে উচ্চশিক্ষায় পুরুষের সমান তহবিল বরাদ্দ হয় নারীদের জন্য। এরপর ক্রীড়াঙ্গনেও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়, এর প্রভাব পড়ে বাকি বিশ্বেও।
লিঙ্গ সমতা এখন দিনকে দিন বাড়ছে, তারপরও বলতে হয়, মহিলা ক্রীড়াবিদরা এখনো অসংখ্য বাধার সম্মুখীন হন। পুরুষদের দলগত খেলা যেমন ফুটবল, হকি, ক্রিকেটে নারীরা বিস্তর ব্যবধানে পিছিয়ে এবং নারীদের ক্ষেত্রও পুরুষদের দখলে। ফেডারেশন বা বোর্ডে কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফেও পুরুষদের সংখ্যাধিক্য—যে কারণে নারীরা প্রায়শই লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন।
শুধু তাই নয় যৌন নির্যাতনও সহ্য করেন মুখ বুজে। কিছু খেলা আছে যেমন জিমন্যাস্টিকস ও ফিগার স্কেটিংকে নারীদের খেলা হিসেবে দেখা হয়; ফুটবল, ক্রিকেট, হকিকে ভাবা হয় পুরুষদের খেলা। সাধারণ ক্রীড়াপ্রেমীরা মনে করে পুরুষালি খেলায় নারীদের অংশগ্রহণ একধরনের ফান, খুব বেশি বৈষয়িক কিছু নয়!
ইতিহাস বলছে লিঙ্গ বৈষম্যের ফলে মহিলা ক্রীড়াবিদদের ওপর অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেই নারীদের মাত্র দশভাগ খেলাধুলা সম্প্রচারের সুবিধা পায়, মাত্র দুই ভাগ খেলাধুলা নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার হয়। যার অর্থ সংবাদকর্মীরা হয়তো বুঝতে পারেন না যে তারা মহিলা ক্রীড়াবিদদের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছেন। বাংলাদেশও এর ভিন্ন নয়। বুঝে না বুঝে চাহিদা থাকলেও নারী ক্রীড়াবিদরা প্রচারের আলো কম পান।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, লিঙ্গগত কারণে নারীদের ওপর কঠোর নজরদারি চলছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে, এটাকে স্বেচ্ছাচারী এবং সীমাবদ্ধ নীতিমালার অংশ বলছে তারা। পুরুষ যে পুরুষ সেই পরীক্ষা দিতে হয় না, তবে নারীকে তার হরমোনের পরীক্ষা দিতে হয় নিয়মিত।
সামাজিক ও পারিবারিক বিপত্তি সাথী তো আছেই, সাথে কর্মক্ষেত্রের পুরুষ কলিগরা যদি লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকান—তবে সেই নারীর অবস্থা আর কী হবে বলুন? বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাফুফে ও বিসিবি’র এখনই সচেতন হওয়ার সময়, নারীর জন্য পরিবেশ আরও ন্যায়সঙ্গত এবং ইতিবাচক করার।
মানজুর মোরশেদ : এডিটর, টি-স্পোর্টস