শীতেও ডেঙ্গু কেন : পরিস্থিতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ
নভেম্বরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে আমি গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম যে, আগামী দুই মাস ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। সেই পূর্বাভাস যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ এখন আমরা প্রতিদিনই পাচ্ছি।
সংখ্যার ভয়াবহতা
বিজ্ঞাপন
এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯৭ হাজার ৩১৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩৯৪ জনের [৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ঢাকা পোস্ট]। তবে এই সংখ্যা কেবল হাসপাতালভিত্তিক ভর্তি রোগীর তথ্য; যা ঢাকার ৭৭টি হাসপাতাল ও ৬৪টি সিভিল সার্জন অফিসের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তুত। অসংখ্য রোগী আছেন যারা বাসায় বা ছোট ক্লিনিকে চিকিৎসা নিচ্ছেন—যারা এই হিসাবের বাইরে। বাস্তব পরিস্থিতি তাই সরকারি সংখ্যার তুলনায় আরও ভয়াবহ।
বিশ্বে অনেক দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে, বিশেষ করে ব্রাজিলে রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। কিন্তু মৃত্যুহারের দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২০২৪ সালে ডেঙ্গুর মৃত্যুহারের তুলনায় ২০২৫ সালে কিছুটা কমলেও এখনো উদ্বেগজনকভাবে বেশি।
বিজ্ঞাপন
শীতেও কেন ডেঙ্গু কমছে না—বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা
বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে এলে এডিস মশার প্রজনন কমে যায়। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণও কমে। কিন্তু ২০২৫ সালের বাস্তবতা ভিন্ন। তার কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়—
প্রথমত, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন তাপমাত্রার স্বাভাবিক তারতম্যকে বদলে দিচ্ছে। শীতের তাপমাত্রা আগের তুলনায় উষ্ণ থাকায় এডিস মশার জীবনচক্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না। মশা তার বংশ বিস্তারের জন্য ২৫–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে আদর্শ মনে করে। আমাদের দেশে শীতেও এখন তাপমাত্রা প্রায়ই এই সীমার মধ্যে থাকে।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশা তার প্রজনন প্রবণতা ও বাসস্থানের ধরন পরিবর্তন করছে। বহু বছর ধরে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে—এডিস এখন শুধু খোলা জায়গার ছোট পাত্র বা বৃষ্টির জমা পানি নয়, ড্রেন, বদ্ধ পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং এমনকি বেজমেন্টেও অনায়াসে প্রজনন করছে।
বাংলাদেশে সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তাপমাত্রা কমে এলে এডিস মশার প্রজনন কমে যায়। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণও কমে। কিন্তু ২০২৫ সালের বাস্তবতা ভিন্ন।
আমাদের গবেষণা দলের পরিচালিত ‘ব্রুটো ইনডেক্স’—যা এডিস মশার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক—অনেক জায়গায় এখনো ২০-এর ওপরে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই সূচক ২০ ছাড়ালে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তাই শীতের মাঝেও সংক্রমণ কমছে না।
কোন কোন স্থানে শীতেও এডিসের বংশবিস্তার চলবে
ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে আমরা দেখেছি, শীতকালে বৃষ্টির অভাবে খোলা জায়গায় পানি কম জমলেও কিছু স্থান এমন রয়েছে যেখানে সারা বছরই পানি থাকে। যেমন—
১। নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি;
২। পানির সংকট আছে এমন এলাকায় টয়লেট–বাথরুমে বালতি বা ড্রামে জমা পানি;
৩। ওয়াসার মিটার সংরক্ষণ চৌবাচ্চায় জমে থাকা পানি;
৪। বহুতল ভবনের পার্কিং-এর মধ্যে গাড়ি ধোয়ার জায়গায় জমা পানি;
৫। বদ্ধ ড্রেন বা নর্দমার ভেতরের পানি;
এই স্থানগুলো শীতকালীন এডিস প্রজননের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। বৃষ্টি না থাকায় এডিস মশা এখন এসব জায়গাকেই লক্ষ্য করে ডিম পাড়বে। ফলস্বরূপ, শীতের ডেঙ্গু কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় বা বাড়িতে সীমাবদ্ধ থাকবে, যা আমরা বৈজ্ঞানিক ভাষায় হটস্পট বলি। এই হটস্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শীতেও ডেঙ্গু ছড়াতে থাকবে।
নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক পথ কী?
শীতকালের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
প্রথমত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো হটস্পট–ভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি সংক্রমিত রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে তার আশপাশে দ্রুত ফগিং কার্যক্রম চালাতে হবে, যাতে ভাইরাসবাহী মশা আর কাউকে সংক্রমিত করতে না পারে। তবে—হটস্পট ছাড়া অন্য কোথাও ফগিংয়ের প্রয়োজন নেই। এটি শুধু অপচয় নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভুলও।
দ্বিতীয়ত, হাসপাতালে যেখানে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে, সেই স্থানেও নিয়মিত ফগিং জরুরি। রোগীদের অবশ্যই মশারির নিচে রাখতে হবে যাতে কোনো মশা তাদের কামড়াতে না পারে। কারণ, একজন সংক্রমিত রোগীকে কামড়ানো মাত্রই সেই মশা ভাইরাসবাহী হয়ে যায়।
তৃতীয়ত, আগামী ১৫ দিন বংশবিস্তার স্থল ধ্বংসের জোরালো অভিযান পরিচালনা করা গেলে ডিসেম্বরেই সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
তবে এ কাজে সিটি কর্পোরেশন একা সফল হতেই পারে না। নগরবাসীর অংশগ্রহণ না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
নাগরিকদের করণীয়—অলৌকিক নয়
খুব সাধারণ নিয়মগুলো হলো—
১। বাড়ির ভেতর বা বাইরে কোনো পাত্রে পানি জমিয়ে রাখতে হলে তা ৩ দিন পরপর সাবান/ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে।
২। বাথরুমের বালতি, প্ল্যান্ট পট বা AC ট্রে—এসবই ডেঙ্গুর সম্ভাব্য উৎস।
৩। ঘরবাড়ির আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা, মশারির ব্যবহার বাড়ানো এবং ডেঙ্গু হলে দ্রুত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ নেওয়া—এসবই জীবন রক্ষার প্রধান উপায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশা তার প্রজনন প্রবণতা ও বাসস্থানের ধরন পরিবর্তন করছে। বহু বছর ধরে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে—এডিস এখন শুধু খোলা জায়গার ছোট পাত্র বা বৃষ্টির জমা পানি নয়, ড্রেন, বদ্ধ পয়ঃনিষ্কাশন লাইন এবং এমনকি বেজমেন্টেও অনায়াসে প্রজনন করছে।
ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি—স্রোতের বিপরীত নয়, বিজ্ঞানকে অনুসরণ করতে হবে
ঢাকায় ডেঙ্গু বহু বছর ধরে মহামারির মতো আচরণ করছে। তাই ভবিষ্যতে যেন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল কিংবা চট্টগ্রামে একই পরিস্থিতি না দেখা দেয়, সেজন্য প্রতিটি নগরের প্রশাসনকে এখনই সতর্ক হতে হবে।
মেয়র আসে, মেয়র যায়—কিন্তু ডেঙ্গু যায় না। তবু আমি বিশ্বাস করি, যারা এখন মশা–ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন, তারা বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে এ বিপদ সামাল দেওয়া সম্ভব।
আগামী মাসগুলোয় কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়বে—তাই এখন থেকেই উদ্যোগী হলে শুরুতেই একে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। এ ক্ষেত্রে নগর প্রশাসনের যথাযথ তৎপরতা অত্যন্ত প্রয়োজন।
ডেঙ্গু আজ সর্বকালীন সংকট। শীত মানেই নিরাপদ—এই ধারণা এখন আর সত্য নয়। বিজ্ঞানভিত্তিক মশা নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতা, নাগরিক দায়িত্ব এবং প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ—এই চারটিই পারে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার : কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com