আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস
সুসংহত মানবাধিকার বৈশ্বিক গণতন্ত্রায়নের পূর্বশর্ত
বৈশ্বিক বিভিন্ন ঘটনা এবং দুর্ঘটনার আলোকে সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার অন্যতম বহুল চর্চিত বিষয় হলেও উৎপত্তিগত দিক বিবেচনা করলে এটি অনেক পুরোনো। সেই ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা (Magna Carta)-এর মধ্য দিয়ে শাসকের সর্বময় ক্ষমতার লাগাম টানার শুভ পরিণতির পর মানবকল্যাণে মানবাধিকার নানা মাত্রায় সংযোজিত হয়ে আজ আন্তর্জাতিক আইনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিকভাবে মানুষের মধ্যে সব বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সময়ের পরিক্রমায় মানবাধিকার বিকশিত হয়েছে নানা মাত্রায়। এক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিবর্তনে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, দার্শনিক এবং চর্চাগত কিছু বিষয়ের সম্মিলন।
বিজ্ঞাপন
প্রতিটি ধর্মের মূলবাণী মানবকল্যাণ, যা মানবাধিকারের মূলমন্ত্র। সেই সাথে দার্শনিক ভিত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকবৃন্দ সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটলসহ রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে জন লক, রুশোর দৃষ্টিভঙ্গি, যারা জীবন, স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকারের ধারণাকে জনপ্রিয় করেছেন এবং সামাজিক চুক্তি মতবাদের মধ্য দিয়ে এই ধারণাকে আরও অনেকটা পোক্ত করেছেন।
১৭৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে, জীবন, স্বাধীনতা এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের এইসব ধারণাকে ধারণ করে। পরবর্তীকালে ফরাসী বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানবাধিকারের সর্বজনীনতা আরও ব্যাপকতা লাভ করে।
বিজ্ঞাপন
মানবজাতির ইতিহাসে দুটি মহাযুদ্ধ বিশ্ববিবেককে দারুণভাবে নাড়া দেয়। কেবল ক্ষমতার লড়াইয়ে কয়েক কোটি মানুষের হতাহত হওয়া সবাইকে এই বার্তাই জানান দিয়েছিল যে ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন ঘটলেও এর অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য ছিদ্র, যার ফলে একটি ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থা থেকে বিশ্বকে সারিয়ে তুলতে হলে এর সর্বাপেক্ষা টেকসই নিরাময় হচ্ছে কার্যকর মানবাধিকারের ব্যবস্থাপনা এবং সুরক্ষা। ১৯৪৫ সালে সানফ্রানসিসকো চুক্তির মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের যে যাত্রা শুরু হয়, এর সর্বাগ্রে ছিল মানবাধিকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় অঙ্গীকার।
ঐতিহাসিকভাবে মানুষের মধ্যে সব বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সময়ের পরিক্রমায় মানবাধিকার বিকশিত হয়েছে নানা মাত্রায়। এক্ষেত্রে মানবাধিকারের বিবর্তনে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে ধর্মীয়, দার্শনিক এবং চর্চাগত কিছু বিষয়ের সম্মিলন।
জাতিসংঘ সনদের প্রারম্ভিকায় বলা আছে, ‘ভবিষ্যৎ বংশধরদের যুদ্ধের অভিশাপ থেকে বাঁচাবার জন্য, যে অভিশাপ আমাদের জীবনকালে দুই দুইবার মানবজাতির কাছে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা বহন করে এনেছে এবং মৌল মানবাধিকার, মানুষের মর্যাদা ও মূল্য এবং ছোট-বড়, জাতি ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান অধিকারের প্রতি আস্থা পুনর্ব্যক্ত করার জন্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন চুক্তি এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন উৎসপ্রসূত বাধ্যবাধকতার প্রতি সম্মান বজায় রাখার মতো অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য, ব্যাপকতর স্বাধিকারের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রগতি সাধন, জীবনমান উন্নয়নের জন্য এবং এ উদ্দেশ্যে পরস্পর সুপ্রতিবেশী হিসেবে শান্তিতে বসবাস ও সহিষ্ণুতার অনুশীলন করতে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের জন্য আমাদের শক্তি সংহত করতে ও সাধারণ স্বার্থ ছাড়া যে সামরিক শক্তি ব্যবহার করা যাবে না এ বিষয় নীতি গ্রহণ ও পদ্ধতিগত ব্যবস্থার মাধ্যমে সুনিশ্চিত করতে এবং সব জাতির অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ করতে, উল্লিখিত উদ্দেশ্যগুলো চরিতার্থ করতে করার জন্য আমরা আমাদের সব শক্তি একত্র করতে স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।’
উপরোক্ত অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে জাতিসংঘ তার সব কর্মপ্রচেষ্টায় বিভিন্নভাবে মানবাধিকারকে এই সনদের বিভিন্ন ধারায় আলোকপাত করেছে। সনদের ১ (৩) অনুচ্ছেদে এক্ষেত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা মানবিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার বিকাশ সাধন ও মানবিক অধিকার ও জাতিগোষ্ঠী, স্ত্রী-পুরুষ, ভাষা বা ধর্ম নির্বিশেষে সবার মৌল স্বাধিকারসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদানে উৎসাহ প্রদান।’
উপরোক্ত ধারণাগুলোর সর্বজনীন বিকাশের উপায় হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয় মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র। ৩০ অনুচ্ছেদের এই ঘোষণাপত্র তিনভাগে বিভক্ত, যার মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানবাধিকার, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার।
এই ঘোষণাপত্রকে আধুনিক সময়ে মানবাধিকারের ম্যাগনাকার্টা বলা হয়ে থাকে, যেখানে সমানাধিকার, সব ধরনের বৈষম্যের বিলোপ এবং দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রাপ্যতার নিশ্চয়তার কথা বলা রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১ অল্প কথায় অনেক কিছুই বলে দেয়, ‘আমরা সবাই স্বাধীনভাবে এবং সমমর্যাদা ও অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।’
মানবাধিকারের এই ঘোষণাপত্র মানবাধিকার সংক্রান্ত নানা বিষয়ে পরবর্তী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তৎপরতাকে আন্তর্জাতিক আইনের অনুষঙ্গ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন, যা সশস্ত্র সংঘাতের সময় মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এবং যারা যুদ্ধে অংশ নেয় না (যেমন বেসামরিক নাগরিক) তাদের রক্ষা করতে তৈরি করা হয়েছে, যা যুদ্ধের উপায় ও পদ্ধতি সীমিত করে এবং মানবিকতার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, ১৯৬৬ সালের জাতিসংঘ কর্তৃক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্বলিত আন্তর্জাতিক কোভেন্যান্ট, একই বছরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্বলিত আন্তর্জাতিক কোভেন্যান্ট।
নারীর মানবাধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৯ সালের নারীর প্রতি সব বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত কনভেনশন পরবর্তী সময়গুলোয় বৈশ্বিক পরিসরে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বর্তমান সময়েও নারীর অধিকার সুরক্ষায় ব্যাপকভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে।
আরও পড়ুন
১৯৮৬ সালের শিশু অধিকার সনদ শিশুর সুস্থ বিকাশের মাধ্যমে আগামী দিনের সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলোর জন্য এক ধরনের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও জাতিসংঘের উদ্যোগে আরও ছোট বড় কিছু আয়োজন সরাসরি মানবাধিকারের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে, সাথে রয়েছে কিছু আঞ্চলিক মানবাধিকার উদ্যোগ, যার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে ইউরোপীয় মানবাধিকার কমিশন।
মানবাধিকার রক্ষায় বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা দৃশ্যমান থাকলেও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এর চর্চার ধরনের ভিন্নতা মানুষের উদ্বেগকে বাড়িয়ে তোলে।
আজকের সময়ের পশ্চিমা দাপটশালী রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক মানবাধিকারের গুরুত্বের কথা বললেও এর চর্চাকে নিজ দেশে যেভাবে নিশ্চিতকল্পে কাজ করে যাচ্ছে, অপরাপর দেশের ক্ষেত্রে তাদের আচরণের ভিন্নতা মানবাধিকারের চর্চার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা এনে দিয়েছে।
আজকের সময়ের মার্কিন মদদে ইসরায়েলের বর্বর আচরণে ফিলিস্তিনির সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একই সাথে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী সব রাষ্ট্রের সমমর্যাদার বিধান অনেকাংশেই অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী কিছু সদস্য রাষ্ট্রের আচরণের দ্বারা।
রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে হামলা, চীন কর্তৃক শক্তিসাম্য রক্ষার স্বার্থে উত্তর কোরিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা মিয়ানমারে জাতিগত নিধনে প্রচ্ছন্ন সমর্থন—এসবকিছুই মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের পরিপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ফিলিস্তিনের গণহত্যাকে বৈধতা দিচ্ছে, আবার অন্যদিকে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের নিরীহ মানুষের হত্যাকে নিন্দা জানাচ্ছে, ভেনেজুয়েলায় মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা–এসবকিছুই মানবাধিকারের ধারণাগুলো নিজেদের মতো করে ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুসরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অন্যতম নির্দেশ। এক্ষেত্রে আমরা দেখছি এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে নেই বরং এর নেপথ্যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের মানবাধিকার উন্নয়নে ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২১ (১) এবং ২১ (৩) অনুচ্ছেদে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠনে জনগণের ক্ষমতায়নের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। ২১ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ‘প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের শাসন পরিচালনায় অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে।’
একইভাবে ২১ (৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, ‘জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের শাসনক্ষমতার ভিত্তি, এই ইচ্ছা নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যক্ত হবে; গোপন ব্যালট কিংবা সমপর্যায়ের অবাধ ভোটদান পদ্ধতিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
অনেক দেশেই এই ভোটদান পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ। গোপন ভোটদানের বিধান থাকলেও নির্বাচন প্রভাবিত করা, নির্বাচনে অংশগ্রহণ সীমিতকরণ এবং ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক তৎপরতা অনেক জায়গায় মানুষের অধিকার হেয় করছে, যার মাধ্যমে মানবাধিকারের সর্বজনীনতা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যেন মানবাধিকারের মৌলিক শিক্ষা আরও ব্যাপকতা পায়, যার মধ্য দিয়ে মানুষ অধিকার সচেতন হতে পারবে এবং নিজেরাই নিজেদের অধিকার রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে।
ড. ফরিদুল আলম : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়