ছবি : সংগৃহীত

১২ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সালমান রুশদি মার্কিন সময় সকাল পৌনে এগারোটায় পশ্চিম নিউইয়র্কের এক সাহিত্য সভায় গুরুতর ভাবে আক্রান্ত ও আহত হয়েছেন।

রুশদি এবং তার সহ-বক্তা হেনরি রিজ মাত্রই যখন আলোচনা শুরু করতে যাবেন, তখনি সিরীয় বংশোদ্ভূত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শৈশব থেকেই অভিবাসী, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও চব্বিশ বছর বয়সী যুবক জনৈক হাদি মাতার স্টেজে উঠে সহসা পঁচাত্তর বছর বয়সী রুশদির ঘাড়ে ছুরি হাতে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান।

হাদি মাতাকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হলেও রুশদির অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেই গোটা পৃথিবী এই মুহূর্তে অবগত। ঐ একই অনুষ্ঠানে রুশদির থেকে মাত্র ৫০ ফুট দূরত্বে বসে থাকা তার লিটারেরি এজেন্ট চার্লি সাভেনর জানিয়েছেন যে, রুশদির একটি চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ঐ চোখে তিনি আর দেখতে পাবেন না, তার হাতের স্নায়ু ছিঁড়ে গেছে এবং পাকস্থলীও ছুরিকাঘাতে আহত।

আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন 

লেখকের চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশের এক বছর পরই বা ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন ইরান সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান আয়াতুল্লাহ খোমেনি প্রদত্ত রুশদির হত্যাকারীর জন্য তিন মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেন। তারপর থেকে তেত্রিশ বছর জীবনের অধিকাংশ সময় আত্মগোপনে থাকা রুশদি শেষ বয়সে এসে মাত্রই কি না যখন আবার প্রকাশ্য সভা-সেমিনারে অংশ নিচ্ছিলেন, তখনি এলো এই আচমকা আঘাত।

জীবনের প্রথম ‘অসফল’ উপন্যাস ‘গ্রিমাস (১৯৭৫)’-এরপর ‘মিডনাইটস চিলড্রেন (১৯৮১)’-এর জন্য রুশদি এপর্যন্ত অর্জন করেছেন ‘বুকার প্রাইজ (১৯৮১), ‘দ্য বুকার অফ বুকার্স (১৯৯৩)’ এবং ‘দ্য বেস্ট অব দ্য বুকার্স (২০০৮)।’ এরপরে তিনি আরও লিখেছেন, ‘শেম (১৯৮৩)’, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস (১৯৮৮)’, ‘হারুন অ্যান্ড দ্য সী অব স্টোরিজ (১৯৯০)’।

হারুন অ্যান্ড দ্য সী অব স্টোরিজ বইটি মূলত ইরান সরকারের ফতোয়া ঘোষিত হওয়ার পর তার কয়েক বছরের কঠিন আত্ম-নির্বাসনে থাকার সময় গল্প বলতে না পারা এক গল্পকথকের কাহিনি, যা পুত্রের জন্য শিশুতোষ রচনার ভঙ্গিতে লিখলেও রুশদি সেখানে তার জীবনের সেই সময়ের সঙ্কটকেই তুলে ধরেছেন।

আরও পড়ুন : সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন এবং বাস্তবের ফাঁক-ফাঁকি 

‘দ্য ম্যুরস লাস্ট সাই (১৯৯৫),’ ‘দ্য গ্রাউন্ড বিনিদ হার ফিট (১৯৯৯),’ ‘ফিউরি (২০০১),’ ‘শালিমার দ্য ক্লাউন (২০০৫)’। শালিমার দ্য ক্লাউন বইটি কাশ্মির সঙ্কট নিয়ে লেখা, এবং ‘দ্য এনচন্ট্রেস অব ফ্লোরেন্স (২০০৮)’।

লেখকের চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশের এক বছর পরই বা ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন ইরান সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান আয়াতুল্লাহ খোমেনি প্রদত্ত রুশদির হত্যাকারীর জন্য তিন মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেন।

এছাড়াও চারটি নন-ফিকশন বই, একটি গল্প সঙ্কলন তিনি লিখেছেন। এসব তথ্য অন্তর্জালের সুবাদে কারোরই তেমন অবিদিত থাকার কথা নয়। কিন্তু আজ রুশদির এই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অতি নগণ্য পাঠক হিসেবে আমার নিজেরই কাছে নিজের বিস্মিত প্রশ্ন যে, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি নিয়ে এত হুলুস্থুল, সেটি কি পুরোপুরি বইটির ফতোয়াদাতারা বা হত্যাদণ্ড কার্যকরী করা সবাই পুরোপুরি আসলে পড়েছেন?

বইটি উপমহাদেশের ভেতর সবার আগে ভারতে নিষিদ্ধ হলেও পরে দ্রুতই পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বইটির কিছু অংশের ফটোকপি আমি পেয়েছিলাম সেই ২০০৫ সালে এবং পড়াও হয়েছিল।

যেটুকু পড়েছিলাম তাতে কিন্তু আদ্যোপান্ত ইসলাম বা ইসলামের মহানবীর সমালোচনা ছিল না। বরং কীভাবে এক মরুচারী সমাজে আরব অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ ও সংগ্রাম এক নয়া ধর্মের জন্ম দেয়, সেই আখ্যানও খানিকটা ছিল বা আছে। বইটি কি আসলে এই ফতোয়াবাজ বা হত্যা চেষ্টাকারীদের কারোরই আদৌ পড়া হয়েছে?

আরও পড়ুন : বইমেলা ও প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ 

বাংলাদেশে বইটি নিষিদ্ধ হলেও অন্তর্জালে খুঁজলেই পুরো বইটি পাওয়া যেত। আমি অন্তর্জাল থেকে নানা বই প্রায়ই ডাউনলোড করে জমিয়েও রাখি। কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল বোধ করি এই বইটি অন্তর্জালেও পাওয়া যাবে না। তবু, যেটুকুই পড়া হয়েছে তাতে বইটিকে আদ্যোপান্ত ইসলাম বিরোধী বলে কিন্তু মনে হয়নি।

বরঞ্চ বইটিতে ‘জাহেলিয়া’ নামে প্রাক-ইসলামি মক্কার যে বিবরণ, ইসলাম ধর্মের প্রাণ পুরুষের বড় হয়ে ওঠা...সবচেয়ে যেটা দুঃখজনক যে একটি বই পুরো না পড়েই যে আমরা উত্তেজিত হয়ে পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে ফেলি, কেউ কি মানবেন যে, এই বইটিতে কেন আরবের অত সব অভিজাতের বিপক্ষে একা ইসলামের নবী দাঁড়িয়ে এবং শুরুতে কিছু দরিদ্র, ক্রীতদাস ও দীনস্য দীনকে সাথে নিয়ে এই ধর্ম কীভাবে বাড়তে থাকে...এমন নির্মোহ বিবরণও আছে?

কুরাইশ অভিজাতরা আজকের ‘কাবা’ বা তখনো ‘কাবা’ যা ছিল দেব-দেবীদের মন্দির, তাকে যে তীর্থযাত্রা বা হজের সময় ব্যবসার কেন্দ্র করে তুলেছিল...তেমন সমালোচনাও আছে? বইটি পুরোটা হয়তো ইসলামের বিপক্ষেও নয়। কিন্তু সারাক্ষণই যদি 'চিলে কান নিয়ে যাওয়ার উত্তেজনা'তেই অস্থির থাকে মানুষ, তাহলে আর কি হবে?

জীবনের প্রথম ‘অসফল’ উপন্যাস ‘গ্রিমাস (১৯৭৫)’-এরপর ‘মিডনাইটস চিলড্রেন (১৯৮১)’-এর জন্য রুশদি এপর্যন্ত অর্জন করেছেন ‘বুকার প্রাইজ (১৯৮১), ‘দ্য বুকার অফ বুকার্স (১৯৯৩)’ এবং ‘দ্য বেস্ট অব দ্য বুকার্স (২০০৮)।’

কী আছে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এ? সত্যি বলতে এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়টুকু লেখক যেন ঠাট্টাই করছেন—এমনকি বিরক্তও লাগতে পারে। আধুনিক ভারতীয় অনুষঙ্গ বেশি। কস্তুরবা থেকে বিনোদন জগতের অমিতাভ বচ্চন—অনেকেই। লেখক কি মূল কাহিনিতে যেতে ইতস্তত করছিলেন বা ভয় পাচ্ছিলেন?

উপন্যাসটি তার ধ্রুপদী রূপ পেতে শুরু করেছে ‘মাহৌন্দ’ বা দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে। ‘মাহৌন্দ’ কি ‘মুহাম্মদ’-এর নামই বদলে দিয়ে করা হয়েছে? ‘জাহেলিয়া’ তো মক্কা বোঝাই যাচ্ছে। রুশদির সৃজনশীলতা তাক লাগিয়ে দেবে যখন প্রথমেই আমরা দেখব যে মক্কাকে ‘জাহেলিয়া’ নামে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। কেন এই নামকরণ? অন্তত বাংলাদেশে বসবাসকারী শুধু মুসলিম নন, শিক্ষিত অমুসলিমরাও জানেন যে, প্রাক-ইসলামি আরব যুগকে ইসলামের ইতিহাসে বলা হয় ‘আইয়ামে জাহেলিয়া।’

আরও পড়ুন : অস্থির সময়ে রবীন্দ্রনাথ কেন এত প্রাসঙ্গিক? 

জাহেলিয়ার যুগ। কেমন ছিল সেই যুগ? প্রতিমা পূজারি ও পৌত্তলিক? যখন কি না ‘অতীতের নারীরা নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াত?’ ইমরুল কায়েসের কবিতার আরব? মদ্যপান ও নৃত্য-গীতে অকুণ্ঠ আরব? ‘কুরাইশ’ গোত্রের নাম পাল্টে করা হয়েছে ‘শার্ক’ অথবা যে পর্বতগুহা বা ‘হেরা’ গুহায় ধ্যান করতেন নবী, তার নাম পাল্টে করা হয়েছে ‘কোনি’। হ্যাঁ, জাহেলিয়া বণিকদের শহরই ছিল।

‘The city of Jahilia is built entirely of sand, its structures formed of the desert whence it rises. It is a sight to wonder at: walled, four-gated, the whole of it a miracle worked by its citizens, who have learned the trick of transforming the fine white dune-sand of those forsaken parts, —the very stuff of inconstancy, —the quintessence of unsettlement, shifting, treachery, lack—of—form, —and have turned it, by alchemy, into the fabric of their newly invented permanence. These people are a mere three or four generations removed from their nomadic past, when they were as rootless as the dunes, or rather rooted in the knowledge that the journeying itself was home.'

উপরের এই একটি স্তবকেই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন মাত্র তিন/চার প্রজন্ম হয় মরু যাযাবরের জীবন থেকে স্থিতিশীল হয়ে ওঠা জাহেলিয়া নগরীর মানুষের কথা। ঝুরঝুরে বালুর এই নগরীতে সবই যেন বালুর মতো। অনিত্য বালুর মতো সবই আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যেতে চায়।

আরও পড়ুন : বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ? 

নগরীর মানুষেরা বালুর সাথে আলকেমির মিশ্রণে তাদের বসতি ও জীবনকে খানিকটা স্থিতিশীল করে তুলতে চায়। এই নগরী বণিকদের নগরী। এই নগরীর প্রধান বা সর্বেসর্বা করিম আবু সিম্বেল যিনি নগরীর সেরা রূপসী হিন্দের বর, বর্ণনাতীত সম্পদের অধিকারী, নগর দুয়ারে ঐশ্বর্যশালী সব মন্দিরের সত্ত্বাধিকারী, অসংখ্য উটের মালিক, বণিক ক্যারাভানগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী ইদানীং ভয়ে আছেন। কে তার ভয়ের কারণ?

মাহৌন্দ—যার মাত্র তিনজন আপাত শিষ্য। এক দরিদ্র পানিবাহক বা ভিস্তিওয়ালা, সালমান দ্য পার্সি নামে ইরান থেকে আগত এক অভিবাসী ও হাবশি ক্রীতদাস বেলাল। জমজমের কূপের সামনে তাদের দেখা যায়। জমজমের কূপের প্রসঙ্গে হযরত ইব্রাহিম ও তার স্ত্রী হাগারের পুরাণও আমাদের শোনান রুশদি।

শোনান আরবীয় সুগন্ধ, নাবাতিয় বণিক, ইহুদি, পারসিকসহ নানা দেশের নানা মানুষে গমগম জাহেলিয়া বা প্রাক-ইসলামি মক্কার কথা। এই নগরীর তিন প্রধান দেবী কারা? আছেন সুন্দরী আল-লাত, অন্ধকারে মুখ ফেরানো ও মসীবর্ণা মানাত যার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে বালুকণা (তিনি নিয়তির দেবী) ও বৃদ্ধা দেবী উজ্জাত।

আছে ‘কালো পাথরের ঘর, দ্য হাউজ অব ব্ল্যাক স্টোন। এই জাহেলিয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে বণিকেরা নিয়ে আসছে মিশর, চীনসহ পৃথিবীর নানা দেশ থেকে কত পণ্যের পসরা। সুন্দরী ব্যালে-ড্যান্স নর্তকীরা নাচছে তীর্থ প্রাঙ্গণে। তবু আবু সিম্বেলের মনে শান্তি নেই কেন?

‘হারুন অ্যান্ড দ্য সী অব স্টোরিজ (১৯৯০)’। হারুন অ্যান্ড দ্য সী অব স্টোরিজ বইটি মূলত ইরান সরকারের ফতোয়া ঘোষিত হওয়ার পর তার কয়েক বছরের কঠিন আত্ম-নির্বাসনে থাকার সময় গল্প বলতে না পারা এক গল্প কথকের কাহিনি, যা পুত্রের জন্য শিশুতোষ রচনার ভঙ্গিতে লিখলেও রুশদি সেখানে তার জীবনের সেই সময়ের সঙ্কটকেই তুলে ধরেছেন)।

তখনো ‘কাবা’র সামনে হজ বা তীর্থযাত্রা থাকতো। তবে তখন সুন্দরী নর্তকীরা সেই তীর্থ প্রাঙ্গণে নাচতো আর সেই নৃত্যের সম্মোহনে তীর্থযাত্রীদের অনেকের হাতের পয়সা-কড়ি লুট হয়ে যেত। তিন দেবী (লাত, মানাত, উজ্জাত)-এর মন্দিরে যত অর্থ জমা হতো, তা কি চলে যেত না অভিজাতদের ঘরে?

আরও পড়ুন : নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা 

আহা, ঐ তো রূপসী হিন্দের বর (এই প্রতিমা পূজারি রূপসী এক মুসলিম যোদ্ধার কলিজা কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছিলেন...ইসলামের ইতিহাসেই আছে...রুশদির বানানো নয়...এতটাই প্রবল ছিলেন সেই রূপসী পিতৃপুরুষের ধর্মের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে) আবু সিম্বেল স্ত্রীর প্রেমিক জেনেও কবি বালকে আদেশ দিচ্ছেন মাহৌন্দের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার জন্য।

আবু সিম্বেল বয়সে অনেক বেশি তরুণতর, চাল-চুলোহীন কবি বালকে ডেকে বলছেন (বাল কি ইমরুল কায়েসের প্রতিভূ এখানে?), ‘আমি জানি তুমি আমার স্ত্রীর সাথে শয্যায় যাও।’ এটা বলেও কবিকে অনুরোধ করছেন মাহৌন্দের বিরুদ্ধে কবিতা রচনার জন্য। কবি বাল (নামে আঁতকে উঠবেন না বাঙালি পাঠক...আরব দেশে এই নামের নিশ্চিত অন্য অর্থ ছিল) অবাক হয়ে ভাবছে যে আবু সিম্বেলের কি মাথা খারাপ হলো যে দু/দশ জন হতদরিদ্র লোক, পানি সরবরাহকারী বা ভিস্তিওয়ালা আর হাবশি ক্রীতদাস বেলালের ধর্মীয় নেতা মাহৌন্দকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে যে তার বিরুদ্ধে কবিতাও লিখতে হবে?

সঙ্কোচ করে প্রেমিকার দারুণ ক্ষমতাশালী, অভিজাত বরকে সে বলেই ফ্যালে যে মাহৌন্দকে নিয়ে কবিতা লেখা কি তার অতি সামান্য কবি প্রতিভার খানিকটা অপচয় হবে না? তিনশ ষাটজন দেবতার বিরুদ্ধে কীভাবে দাঁড়াবে মাহৌন্দের একমাত্র ঈশ্বর? আর কাদের নিয়ে ‘বিপ্লব’ করবে সে? অভিবাসী, ক্রীতদাস আর পানির ভিস্তিওয়ালাদের নিয়ে?

আরও পড়ুন : পঞ্চাশ বছরের সাহিত্যে ভাবনার পরিবর্তন

উত্তরে আবু সিম্বেল বলে যে, এসব বিদ্রুপের শক্তি সে তার কবিতাতেই প্রকাশ করুক। হাজার হোক কবি বাল ও আবু সিম্বেল একই নারীর দুই মানব যখন—একজন বর (আবু সিম্বেল) ও একজন প্রেমিক (কবি বাল)। রুশদির রসিকতার তুলনা হয় না। আবু সিম্বেল বয়সে ঢের বেশি তরুণতর কবি বালের কথায় ভরসা পায় না।

যত দরিদ্র হোক এই নতুন ধর্মের মানুষেরা, কোথাও কি এদের কোনো প্রবল শক্তি আছে যা সবকিছু নড়িয়ে দিতে পারে? আবার মাঝে মাঝে মাহৌন্দ নিজেও যেন ভরসা পান না? আবু সিম্বেল তাকে তিন দেবীকে আল্লাহর কন্যা হিসেবে মেনে নিতে বলেছে—বদলে তাকে জাহেলিয়ার কাউন্সিলে নির্বাচিত করা হবে। আবু সিম্বেল জানেন যেসব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যথোপযুক্ত ‘ক্ষমতাশালীদের সাথে সংযোগের অভাবে’ মাহৌন্দ তাদের মতো (সিম্বেলদের মতো) ক্ষমতা ও প্রতাপ ভোগ করতে পারছে না। এদিকে মাহৌন্দ ভাবেন যে মানুষ কিছুতেই পিতৃপুরুষের ধর্ম বা দেব-দেবীদের ছাড়তে চায় না।

জাহেলিয়া নগরীতে তার কোনো প্রার্থনায় পঞ্চাশজনের বেশি মানুষ হয় না এবং তাদের অর্ধেক হচ্ছে ভিনদেশ থেকে বেড়াতে আসা দর্শনার্থী? তারা এমনিই নগরীর নানা কিছু খুঁটিয়ে দেখছে? গোটা শহরের দেয়াল জুড়ে কবি বালের বিদ্রূপাত্মক কবিতা—

‘Messenger, do please lend a_
_careful ear. Your monophilia_,
_your one one one, ain't for Jahilia_.

বিস্মিত প্রশ্ন যে, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বইটি নিয়ে এত হুলুস্থুল, সেটি কি পুরোপুরি বইটির ফতোয়াদাতারা বা হত্যাদণ্ড কার্যকরী করা সবাই পুরোপুরি আসলে পড়েছেন?

‘আমাদের নিয়ে সবাই হাসি-ঠাট্টা করে’, মাহৌন্দের হতাশায় তার অনুসারীরা বিস্মিত হয়। ‘ধর্মটা কি আমার আর একটু সহজ করা উচিত?’ অনুসারীরা অবশ্য তাকে তার পথে অটল থাকতে বলে।

ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-অপমানে বিধ্বস্ত ইসলামের প্রেরিত পুরুষকে কুরাইশ প্রতিমা পূজারিদের পক্ষ থেকে বলা হলো যেসব দেব-দেবীকে মানার দরকার নেই। শুধু আল্লাহর তিন কন্যা রূপে তিন প্রধান দেবীকে মেনে নিতে হবে।

আরও পড়ুন : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : অপরাজেয় কথাশিল্পী

তারপর? তারপর কি হয় তার সামান্য উদাহরণ এখনো পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়ের মহা গ্রন্থে আছে,

'Near it is the Garden of Abode. Behold, the Lote-tree was shrouded (in mystery unspeakable!) (His) sight never swerved, nor did it go wrong! For truly did he see, of the Signs of his Lord, the Greatest! Have ye seen Lat. and 'Uzza, And another, the third (goddess), Manat?।'

পরের একটি পঙ্‌ক্তি অবশ্য মুছে দেওয়া হয় কারণ ‘শয়তান এসে ভুল মন্ত্রণা দিয়েছিল।‘ আপাত দৃষ্টিতে কুরাইশ প্রতিমা পূজারিরা খুব খুশি হয়েছিল। তারা নামাজও পড়া শুরু করেছিল—তবে তিন দেবীকে তো মানা হয়েছে। কুচকুচে কালো, হাবশি ক্রীতদাস বেলালই অবশ্য মাহৌন্দকে ‘সঠিক পথে’ থাকতে এবং বিভ্রান্ত না হতে জোর দিলেন। 

আরও পড়ুন : অস্ত্র ও ছলনার বিরুদ্ধে মানুষে আস্থা রবীন্দ্রনাথের 

রুশদির এই উপন্যাসে আরও আছে সেই সময়ের প্রাক-ইসলামি আরবের আরও নানা দেব-দেবীর বিবরণ। বইটি এক প্রত্নসময়ের দলিল এবং নৃ-তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহীদের কাছে বইটি উপভোগ্য মনে হবে।

বইটি এদেশে নিষিদ্ধ বলে পুরো পড়া হয়নি বলে আমার সব পর্যবেক্ষণ সঠিক এটা বলছি না। ফেরেশতা জিবরাইলকে নিয়ে কিছুটা পরিহাস করেছেন তিনি এবং সেটা অস্বীকার করা যাবে না।

জ্যেষ্ঠতমা স্ত্রী যখন ষাটোর্ধ্ব এবং বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার সাথে তার পনেরো বছরের কনিষ্ঠতর স্বামীর পুরো দাম্পত্য সম্পর্ক না থাকলেও গভীর মমতার বন্ধনের একটি সুন্দর দৃশ্য রয়েছে এই উপন্যাসে। মুশকিল হচ্ছে, কিছু পড়ে ওঠার আগেই বই নিষিদ্ধ করা, সেন্সরশিপ আরোপ, লেখককে হত্যা, অনুবাদক হত্যা বা এই বিষয়ে কথা বলা যে কাউকে হত্যার তো কোনো অর্থ নেই।

বাংলায় এই বই অনূদিত হতে পারলে সাধারণ পাঠকের জন্য ভাল হতো। বইটি আসলে ভালো কি মন্দ, ইসলাম বিদ্বেষী কি না বা হলেও কতটুকু বিদ্বেষী—সেটা পরের মুখে ঝাল খেয়ে জানার বদলে পাঠক নিজেই বুঝে বিবেচনা করতে পারত।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক