প্রতি বছরের ১১ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘের রাষ্ট্রসমূহে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালিত হয়। এবারে দিবসটি যখন পালিত হচ্ছে, তখন বাংলায় উদযাপিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। অসুর দমনে নারীশক্তির যে উদ্বোধন মন্ত্র উচ্চারিত হয় দুর্গাপূজায়, তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কন্যা দিবসের সুর এবার যেন মিলেমিশে গেছে।

আমাদের সমাজে আবহমান কাল ধরেই নারীশক্তির যে আবাহন সঙ্গীত গীত হয়ে আসছে, তার সঙ্গে আমাদের বাস্তব চিত্রের কি কোনো মিল আছে? দুর্গাপূজা এলেই আমরা সমবেত হই। মাতৃরূপেন সংস্থিতার কাছে নিজেদের সমর্পণ করি, গাই নারীশক্তির জয়গান। এভাবে উৎসবে-পার্বণে বা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা দিবসকে ঘিরে আমরা যে শুদ্ধব্রতে সমবেত হয়, বছরের বাকি দিনগুলোতে বা আমাদের জীবনের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে তার কি কোনো মিল খুঁজে পাই?

এই তো কদিন আগে, ৩০ সেপ্টেম্বর পালিত হলো জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। গণমাধ্যমে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা তার ভূয়সী উদযাপন দেখেছি। যদিও অনেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসটির তারিখ গুলিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু তাতে কী যায় আসে? নিজেদের কন্যা শিশুকে নিয়ে বা দেশের কন্যা শিশুদের অধিকার, প্রাপ্তি আর নিরাপত্তা নিয়ে সকলেই কী অসামান্য লেখা বা ছবিই না শেয়ার করেছেন নিজেদের ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে।

হ্যাশট্যাগে উঠে এসেছে কন্যা শিশুর প্রতি আমাদের স্নেহ, ভালোবাসা আর আদরের কথা। কেবল ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, সাংগঠনিক পর্যায়েও নানা আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস নিয়েও হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম বা সভা-সমিতিতে নানা আলোচনায় পালিত হচ্ছে দিবসগুলো কিন্তু দেশের কন্যা শিশুদের বাস্তব চিত্রটি আসলে কেমন? আমাদের একদিনের উদযাপনের এই মূল উপলক্ষটি বছরের বাকি দিনগুলোতে কেমন থাকে?

করোনাকালে শিশুদের জনসমাগমের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ৬২৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের বেশ বিব্রত হতে হয়। গুগল করে বা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যাদি দেখে বুঝতে পারি, যতই আমরা কন্যা শিশুর স্বর্গীয় বিভার কথা বলি না কেন, যতই মাতৃশক্তির বন্দনা করি না কেন— আমাদের কন্যারা আসলে ভালো নেই।

দেশের নানা প্রান্তে কন্যা শিশু নির্যাতনের সংবাদও উঠে আসে এইসব উদযাপনের মঞ্চে। সারাদেশে নারীর বিরুদ্ধে যে নির্মম নিপীড়নের সংবাদগুলো ছাপা হয়, তা আমাদের উদযাপনকে দ্বিচারিতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেই। আমরা নিজেরাই আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে পারি না, লজ্জায় কুঁকড়ে যাই।
আমি নির্যাতনের পরিসংখ্যানের হিসাবে না-ই গেলাম। করোনা মহামারি কালে গোটা দুনিয়ার শিক্ষা, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থা একটি বড় ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু আমরা যে ধাক্কাটি খেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করাও দুরূহ। দীর্ঘসময় পর যখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হলো, তখন আমরা করোনার এমন এক ফলাফলের মুখোমুখি হলাম, যা অচিন্তনীয় হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক নয়।

গত ১৮ সেপ্টেম্বরে ঢাকা পোস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, কেবল টাঙ্গাইলেই শতাধিক নারী শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এগুলো বাল্যবিবাহ। যশোরের কেশবপুর উপজেলার পরিসংখ্যানও পাই গণমাধ্যমে। এ বছরের আগস্ট মাসে প্রকাশিত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই উপজেলায় গত ১৮ মাসে তিন হাজার বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এর অধিকাংশই বিয়ের পর আর নিজেদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখেনি। এই ধরনের প্রতিবেদনও আমরা গণমাধ্যমে পেয়েছি। অর্থাৎ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে সবসময়ই আমরা যে চিন্তার মধ্যে থাকি, তার প্রেক্ষিত আরও বেড়েছে, এখানে উল্লেখযোগ্য হারে যুক্ত হয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের হার।

এ তো গেল শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ছিটকে পড়া আমাদের কন্যা শিশুদের কথা। কিন্তু যে কন্যা শিশুরা যুক্ত থাকছেন শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে, তারাও কি নিরাপদ? মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন শিশু অধিকার বিষয়ক আধেয় বিশ্লেষণ থেকে যে তথ্য আমাদের জানিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে শিশুদের জনসমাগমের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ৬২৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ শতাংশ।
এই গবেষণার সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্যটি হচ্ছে, শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ থাকতে পারছে না। ফলে দেশজুড়ে আমাদের কন্যা শিশুরা যে নিরাপদ নেই, নানাভাবে তাদের ওপর নেমে আসছে নির্যাতনের খড়গ, এ বিষয়গুলো কি আমাদের একদিনের উদযাপনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়?

উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বণ্টনে কন্যা সন্তানের প্রতি যে বৈষম্য করা হয়, তার দায় কেবল তো রাষ্ট্রের নয়; বরং অনেকখানিই ব্যক্তির...

প্রশ্ন হতে পারে, ব্যক্তি এখানে কতটুকুইবা সরব হতে পারেন? আমি কোনো উদযাপন বা পালনের বিরুদ্ধে নই, বরং এই উদযাপন মন্ত্রেই আমাদের পৌঁছাতে হবে কন্যা শিশুর জন্য নিরাপদ পৃথিবীর কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ব্যক্তিজীবনের দ্বিচারিতা কি এখানে প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনার যোগ্য নয়?

বাংলাদেশসহ আরও বেশ কিছু দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে একটি বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচিত হয় বলেই সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হলেও এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে একাধিকার এ বিষয়ে ইতিবাচক বক্তব্য উপস্থাপন করলেও কোথায় যেন একটি গলদ রয়েই গেছে। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বণ্টনে কন্যা সন্তানের প্রতি যে বৈষম্য করা হয়, তার দায় কেবল তো রাষ্ট্রের নয়; বরং অনেকখানিই ব্যক্তির, যেহেতু একজন ব্যক্তি চাইলে সম্পত্তি সমবন্টন করতে পারেন। কিন্তু কন্যা শিশুর জন্য গর্বিত পিতা কিংবা বোনের জন্য গর্বিত ভাইটি কিন্তু শেষ বিচারে গিয়ে নারীকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। পরিস্থিতি এমন যে, নারী এ নিয়ে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, কখনো কখনো মেনেও নেন, যেহেতু এখানে ধর্মের বিধান খাটানো হয়।

মৌলবাদীরা যেভাবে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে নারীকে, তাকে প্রতিহত করতে হলে নারীর নিজেরও অধিকার সচেতন হওয়া জরুরি।

২০১১ সালে ঘোষিত নারী নীতির বিরুদ্ধে নানাভাবে মৌলবাদী অপশক্তি ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেছে। যদিও ১৯৯৭ সালে ঘোষিত মূল নারী নীতির সঙ্গে তার বেশ কিছু পার্থক্য আছে, তবুও এই নীতিটি সর্বত্র বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার যদি আন্তরিক হন, তবে আমাদের কন্যা শিশুদের নিরাপত্তা ও নিরাপদে বেড়ে ওঠার বিষয়ে বাধা অনেক কমে আসবে। আর তখনই সার্থক হবে আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবসের মূলভাব। তার আগ পর্যন্ত পালনে, উদযাপনে নারীশক্তির প্রত্যয়কে সঙ্গে নিয়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।

সঙ্গীতা ইমাম ।। শিক্ষক, শিশুসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী