ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আমাদের মুক্তি সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত জাদুঘর। ক্যাম্পাসের পথে পথে, কোনায় কোনায় লুকিয়ে আছে ইতিহাস। ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার রাস্তাটুকু যেন এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি।

এখন যেখানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ, ১৯৫২ সালে সেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, সকল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলাভবনের সামনের আমতলায় সমাবেশ শেষে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল যাচ্ছিল প্রাদেশিক পরিষদ ঘেরাও করতে। তখন অধিবেশন চলছিল। আর তখন অধিবেশন বসতো এখনকার জগন্নাথ হলে। এখন যেখানে অক্টোবর স্মৃতি ভবন, আগে সেখানে ছিল একটা মিলনায়তন।

১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর সে মিলনায়তন ধসে অনেক প্রাণহানি ঘটে। ১৯৪৭ সালের পর সে মিলনায়তনেই বসতো প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিও সেই মিলনায়তনেই বসেছিল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের লক্ষ্য ছিল সেই প্রাদেশিক পরিষদ ভবন। সেখানে গিয়ে পরিষদ সদস্যদের কাছে দাবি তুলে ধরাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি এখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ইতিহাসে যিনি শহীদ আসাদ নামেই পরিচিত।

তখনকার কলাভবন, আজকের মেডিকেলের জরুরি বিভাগ থেকে মিছিল বেরিয়ে প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে যেতে চাইলে আজকের যেখানে শহীদ মিনার, সেখানে পৌঁছতেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। সে ইতিহাস সবার জানা। সেই রাস্তাতেই লুকিয়ে আছে আরেক অগ্নিগর্ভ ইতিহাস। সেই রাস্তা ধরে এগোলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের আগের মূল গেট পার হয়ে একটু এগোলেই রাস্তার বা পাশে ছোট্ট একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে। এমনিতে আড়ালেই থাকে। খুব নজর করে না দেখলে চোখেও পড়ে না।

১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি এখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, ইতিহাসে যিনি শহীদ আসাদ নামেই পরিচিত। শহীদ আসাদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকলেও আমাদের মননে আর ঢেউ তোলে না আসাদের আত্মত্যাগ। নরসিংদীর শিবপুরের ধানুয়া গ্রামে আসাদের সমাধিতে এখন অবহেলার ধুলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার স্মৃতিস্তম্ভও স্মৃতির ধুলায় আচ্ছন্ন।

ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগ থেকে শহীদ মিনারের দিকের রাস্তাটি ধরে আমি যতবার হাঁটি, বারবার শিহরিত হই-কল্পনা করার চেষ্টা করি ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বা ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি কেমন ছিল এই সড়কের অবস্থা!

একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছিল আমাদের বিজয়। কিন্তু তার আগে আছে ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন পরিণতি পেয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম চূড়ান্ত গতি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি আসাদের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালির মনে স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়। পশ্চিমাদের শোষণ-বঞ্চনায় সে বীজে চারা গজায়, পরিণত হয় মহিরুহে। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় ৬ দফা দাবি পেশ করেন। দ্রুতই তা বাঙালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়।

৬ দফা আন্দোলনে ভীত পশ্চিমারা শেখ মুজিবকে মোকাবিলায় ভিন্ন কৌশল নেয়। ১৯৬৮ সালে দায়ের করা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান আসামি করা হয় শেখ মুজিবকে। প্রতিবাদে রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতা। শেখ মুজিবের ৬ দফা আর ছাত্রদের ১১ দফা মিলে এক অসামান্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

১৯৬৮ এর শেষ দিকে শুরু হওয়া সে আন্দোলন চূড়ান্ত গতি পায় ৬৯ এর শুরুতে। পরবর্তীতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া সে আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গটা দিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান, নিজের জীবন দিয়ে। আসাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে হুট করে মারা যাওয়া কেউ নয়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান ছিলেন সে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, মিছিলের সামনের কাতারের নেতা। আসাদ তাই ছিলেন পুলিশের টার্গেট।

আসাদের মৃত্যু গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে বদলে দেয়। আসাদের আত্মাহুতির একমাসের মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি তখনকার সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়, মুক্তি পান শেখ মুজিব। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তখনকার রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আর আসাদের আত্মাহুতির দুই মাসের মধ্যে পতন ঘটে লৌহমানব আইয়ুব খানের এক দশকের স্বৈরশাসনের। তারপর দায়িত্ব নেন আরেক সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান। আসে ৭০-এর নির্বাচন, তার পথ ধরে আসে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামে ২০ জানুয়ারি একটি মাইলস্টোন, আসাদ এক অবিনশ্বর প্রেরণার নাম।

আসাদের স্মৃতি আজ একে একে মুছে যেতে বসেছে, আমাদের স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাচ্ছেন আসাদ। যদিও রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘আসাদ গেট’ নামে এক তোরণ আজও আসাদের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যাওয়ার রাস্তাটির নাম আসাদ এভিনিউ। তবে আসাদ গেট বা আসাদ এভিনিউর সাথে শহীদ আসাদের সরাসরি কোনো স্মৃতি নেই।

আসাদ মিছিলে পুলিশের গুলিতে হুট করে মারা যাওয়া কেউ নয়। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান ছিলেন সে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, মিছিলের সামনের কাতারের নেতা। আসাদ তাই ছিলেন পুলিশের টার্গেট।

আইয়ুব খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে মোহাম্মদপুর এলাকার ১৫টি বাড়ি বিভিন্ন জনকে বরাদ্দ করেছিলেন। তার সম্মানেই মোহাম্মদপুরে ঢোকার মুখে একটি তোরণ বানানো হয়, যার নামকরণ করা হয় তার নামেই- আইয়ুব গেট, সামনের রাস্তাটি হয় আইয়ুব এভিনিউ। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার পর জনতার মুখে মুখে আইয়ুব গেট হয়ে যায় আসাদ গেট, আইয়ুব এভিনিউ হয়ে যায় আসাদ এভিনিউ।

কাকতালীয়ভাবে আমি এখন আসাদ এভিনিউতে থাকি। তবে আরেকটি কাকতাল আমাকে গর্বিত করে। আমার জন্ম ১৯৬৯ সালের আগস্টে। আমার জন্মের আগেই গণঅভ্যুত্থানে টালমাটাল দেশ। ৬৯ সালের জন্ম নেওয়া আমার রক্তের ভেতরে সবসময়ে একটা আন্দোলনের দামামা বাজে।

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছি কর্মী হিসেবে। তাছাড়া শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চসহ সকল গণতান্ত্রিক, ন্যায্য আন্দোলনে কর্মী হিসেবে বা পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে মাঠে থেকেছি, পাশে থেকেছি।

যে চেতনায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল; সেই উন্নত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আন্তরিক থাকি। মানবাধিকার রক্ষা, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার থাকি। আমার মতো আরও অনেকে এই সোচ্চার থাকার অনুপ্রেরণা পেয়েছি আসাদের কাছ থেকে।

শহীদ আসাদের মৃত্যু বাঙালির চেতনায় এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। শিল্পীর তুলিতে, কবির কলমে উঠে আসে সেই ইতিহাস। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান দেখেই হেলাল হাফিজের অমর কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’তে লিখেছিলেন—

‘কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে

কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়।

যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

আর আমাদের সেরা কবি শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ তো এখন ইতিহাসেরই অংশ-

‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা

সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;

আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com