ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা হলো, দেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা তাদের ক্ষমতা মাপেন তারা কতটা আইন ভাঙতে পারেন, তারা কতটা গোঁয়ার হতে পারেন, তারা কতটা মানুষের ক্ষতি করতে পারেন ইত্যাদি দিয়ে। এ যেন পদার্থবিজ্ঞানের বাইন্ডিং এনার্জি (Binding Energy) মাপার মতো।

পরস্পর আকর্ষণ বল দ্বারা আবদ্ধ থাকা দুই বা ততোধিক বস্তুকে আলাদা করতে বাহির থেকে যেই পরিমাণ শক্তি প্রয়োগ করতে হয় সেটাই হলো তাদের বাইন্ডিং এনার্জি। বাংলাদেশের ক্ষমতাবানরা মনে হয় পদার্থবিজ্ঞানের এই অংশটা খুব ভালোভাবে আত্মস্থ করে প্রয়োগ করতে জানেন। উল্টো পথে গিয়ে, উল্টো কাজ করতে পারাকেই নিজের ক্ষমতা মাপার ব্যারোমিটার ভাবে। 

আমাদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেকোনো সমস্যার অঙ্কুরে সমাধান করতে জানেন না। কারণ তাদের মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ থাকে। কারণ তাদের নিয়োগ দলীয় সরকার, দলীয় স্বার্থ রক্ষায় সরকার দিয়ে থাকে। ফলে একটা অদৃশ্য সুতা দিয়ে সরকার তাদের সুরক্ষা দেয় আর তারা হুকুম মেনে সরকারের স্বার্থ পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ওই অদৃশ্য সুতার অস্তিত্ব টের পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাও মনে করেন তাদের গদির পেছনে ক্ষমতার একটা প্রচ্ছন্ন হাত আছে। এরা সর্বদা সেই ক্ষমতার ছোট্ট একটি অংশ হতে পেরেই নিয়োগ কর্তার পূজায় ব্যস্ত থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যায়। প্রশাসন সেই আন্দোলনকে সামাল দিতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীরা যখন ভিসির পদত্যাগ চায় তখন সরকার ভিসির পক্ষে চলে যায়। কারণ একে তারা সম্মান বাঁচানো মনে করে। কারণ ভিসিতো তাদের নিয়োগ দেওয়া দলেরই একজন। তারা ভাবে, এত বড় সাহস আমি যাকে ভালো ভেবে নিয়োগ দিলাম তার বিরুদ্ধে আন্দোলন? প্রশ্ন হলো, যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি কি যোগ্য কেউ?

শাবিপ্রবি বাংলাদেশের নবীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সেখানে অনেক অধ্যাপক আছেন যাদের গবেষণা এবং একাডেমিক ডিগ্রি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের চেয়ে ভালো।

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির কথাই ধরুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের পদত্যাগের কথাই ধরুন কিংবা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর পদত্যাগের দাবির কথাই ধরুন। সরকার সহজে তা মানেনি। জলকে ঘোলা করেই তারপর দাবি মেনেছে।

সরকারকে মানতে হবে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো যোগ্য মানুষকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। শাবিপ্রবি বাংলাদেশের নবীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সেখানে অনেক অধ্যাপক আছেন যাদের গবেষণা এবং একাডেমিক ডিগ্রি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের চেয়ে ভালো। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতা ছিলেন, ডিন ছিলেন ইত্যাদি কোনো যোগ্যতা মনে করি না কারণ এইসব হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আমরা জানি, ভালো একাডেমিক শিক্ষকরা নির্বাচনেও যায় না আবার নিজেরা ভালো ভোটারও না। যদি ভালো ভোটার হতো তাহলে যখন যেই দল যায় সেই দলকে প্যানেল ধরে ভোট দিত না।

উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পিএইচডি ডিগ্রি নেই। বর্তমান বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য পিএইচডি ডিগ্রিও যথেষ্ট না। সাথে পোস্ট-ডক অভিজ্ঞতা এবং একই সাথে ভালো মানের গবেষণা লাগে। এর মধ্যে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের একটি ভিডিও আলাপ শুনলাম। কি বলেছে শুনবেন? ‘জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদেরকে সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না। কারণ তারা সারারাত ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করে!’ এই কথা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্বন্ধে এই ধারণা তিনি পোষণ করেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা কি ভালো বউ হওয়ার জন্য পড়তে আসেন? বিদেশে তো একই হলে একই ভবনে ছেলেমেয়ে একসাথে ভিন্ন রুমে থাকে। আমি নিজেও লন্ডনে এইরকম ব্যবস্থায় থেকেছি।

একটা সময় ছিল, যখন সরকার সেরা মেধাবী মানুষদের উপাচার্য হওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। তারপর যাকে অনুরোধ করা হতো তিনি কিছু শর্ত দিতেন, তারপর দায়িত্ব নিতেন। আর এখন…

ছেলেমেয়ে একসাথে থাকায় কোনো সমস্যা তো হয়নি। সামনে আমার কন্যাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। সেও রাত বিরাতে বাইরে থাকবে। না থাকলেই বরং ভাববো আমার কন্যার কোনো সমস্যা আছে। এইরকম ভাবনার একজন মানুষকে সরকার কীভাবে উপাচার্য নিয়োগ দিল? ধরলাম, আগে জানতো না। এখন জানার পর কেন সময়ক্ষেপণ করছে?

উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের অন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকরা তার বক্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে। তাছাড়া বিএনপি যখন ক্ষমতায় তখন তিনি বিনএনপি পন্থী সাদা দল করতেন। শুনেছি, তিনি বিএনপি আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিয়া চেয়ার করার প্রস্তাবক।

আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে আওয়ামী পন্থী নীল দলে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন হন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হন। প্রশ্নপত্র ফাঁসে উনার সম্পৃক্ততা আছে বলে কেউ কেউ বলেন। উনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীও। ডক্টরেট ডিগ্রি নেই এই অধ্যাপকের। এতকিছুর পরেও সরকার কেন এখনো তাকে পদত্যাগে বাধ্য করছেন না? তা পরিষ্কার নয়।

তাছাড়া একজন ভিসি হবেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন পূজনীয় ব্যক্তি। যার নামে এত নালিশ, এত আন্দোলন তারপরেও তিনি পদটি কীভাবে আঁকড়ে ধরে আছেন? উপাচার্য পদ একটি দায়িত্ব। এটি ক্ষমতা দেখানোর পদ বা লোভনীয় পদ না। তাহলে শিক্ষার্থীরা চায় না তবুও কেন থাকতে হবে?

একটা সময় ছিল, যখন সরকার সেরা মেধাবী মানুষদের উপাচার্য হওয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। তারপর যাকে অনুরোধ করা হতো তিনি কিছু শর্ত দিতেন, তারপর দায়িত্ব নিতেন। আর এখন…

শুনেছি, জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় তখন তিনি একজন সহযোগী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপিকাকে সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য নিয়োগ দেন। তারপর তাকে অধ্যাপক বানানোর জন্য তৎকালীন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরীকে অনুরোধ করেন। উপাচার্য বলেছিলেন, ‘তাকে নিয়ম মাফিক আবেদন করতে বলুন। নিয়ম মেনে সকল যোগ্যতা থাকলে এবং নিয়োগ বোর্ড যোগ্য মনে করে সুপারিশ করলে হবে।’

উপাচার্যদের এমনই হতে হয়। গতকাল এক প্রতিবেদনে দেখলাম, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন বলছেন, ‘সরকার চাইলে উনি পদত্যাগ করবেন।’ নিয়োগকর্তার প্রতি কতটুকু আস্থাভাজন তিনি! অথচ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, বিক্ষোভ করছে তা যেন কেউ শুনছে না। আমাদের সরকারেরা এমন কেন? এরা কেন আবর্জনা দূরা না করে সময়ক্ষেপণ করে। এইটা আমার মাথায় আসে না।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়