ছবি : সংগৃহীত

নৃবিজ্ঞানের এক ব্যাচে একজন আচার্য ছিলেন। অমুক কুমার আচার্য। মনে আছে, একদিন বটতলা দুপুরবেলা একত্রে খেতে খেতে ওকে বলছিলাম, এত মানুষ উপাচার্য হবার জন্য জান কুরবান করে দিচ্ছেন, আর ও এমনিতেই ছোটবেলা থেকে আমৃত্যু আচার্য হয়ে বসে আছে। খানিকটা সলজ্জ হয়ে ও জানালো, ‘জ্বি স্যার এটা কেউ কেউ বলে।’ ওকে খানিক বিব্রত দেখে এ নিয়ে আর রসিকতা বড় করিনি। কিন্তু এটাও ভাবলাম যে, বাংলাদেশে ব্যাপকহারে বাংলা পরিভাষার চল নেই বলে ওর পক্ষে কিছুটা আচার্য হিসাবে রঙ্গরস কম সামলাতে হয়েছে। 

বাংলাদেশে মোটের উপর ভাইস-চ্যান্সেলর ও চ্যান্সেলর শব্দতেই লোকে বেশি আরাম পান। তাও উপাচার্য যা ও যতখানি উচ্চারিত হয়, আচার্য তাও হয় না। হঠাৎ করে, তবে প্রাসঙ্গিকভাবেই, ক্লাসরুমের এক কোনায় বসে থাকা নিতান্ত নিরীহ, পরিবারের পদবীর কারণে আচার্য, এই শিক্ষার্থীর কথা মনে পড়ল। তিনি বেশ লাজুক ছিলেন। অন্তত ক্লাসরুমের পরিবেশে অধিক কথা বলার লোক নন। কিন্তু পদাধিকার বলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যিনি আচার্য তিনি কেন নানান কিছুতে এরকম চুপচাপ থাকেন তা ভেবে বের করা খুবই দুরূহ। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তিনি বিশেষ কিছু বলার বা করার কারণ পান না।

তার ডেপুটিরা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা, নানান কারণে খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। বস্তুত, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে এর উপাচার্যরাই বেশি খবর-উৎপাদক। তা সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিদায়কালে এক কলমের খোঁচায় তিন শিক্ষকের চাকরি খেয়ে ফেলার কারণে হোক, কিংবা গোপালগঞ্জের বশেমুরবিপ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিংস্রভাবে সাংবাদিক হেনস্তা করার কারণে হোক, জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার দাবি-অনুযায়ী ঘুষ প্রদানের কারণে হোক, বেরোবির ভিসি টাই-পরা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম কিংবা ঢাকা বসে প্রশাসন পরিচালনের কারণে হোক। আসলে খবরের সীমা নেই কোনো। 

তালিকা করতে বসলে আর কিছু আর করা হবে না। তবে ঢাকা থেকে পরিচালনের অভিযোগটা বেরোবির সাবেক ভিসির প্রতি নাহক অভিযোগ। তিনি কিছুতেই একা নন, যারা কর্মক্ষেত্রে যেতে কম ইচ্ছুক থাকেন। টাইয়ের বিষয়ে তার আগ্রহ একটু থাকতে পারে। কিন্তু তিনি বিএনসিসির ক্যাডেট হিসেবে মেজর পর্যন্ত বিকশিত হবার পরও সহকর্মীদের যে ক্যাডেটের ইউনিফর্ম পরানোর কোনো হুকুম জারি করেননি তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এমনকি তার বিরুদ্ধে ৭৯০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্রেও এরকম কোনো অভিযোগ আছে বলে শোনা যায়নি।

উপাচার্য পদটির (শব্দ অর্থে) সাথে, উপাচারের কোনোই সম্বন্ধ নেই। কিন্তু উপাচার্য পদটির (চেয়ার অর্থে) সাথে উপাচারের পুরাপুরি সম্বন্ধ আছে। এতটাই আছে যে, কোনটা উপাচার আর কোনটা উপাচার্য তা আলাদাই করতে পারবেন না। অন্তত বর্তমান বাংলাদেশে। অনেকটা মোল্লা সাহেবের বিড়াল আর মাংসের মতো। উপাচার্য হয়তো একটু সকালে স্বাস্থ্যহণ্টন দেবেন। তো, তার আগে পেছনে ৭০ জন হয়তো দৌড়াচ্ছেন। নিছক তোয়াজ হিসাবে দেখলেও তা ভুল হবে। এটা তোয়াজও বটে, তদ্বিরও বটে। ভিসি সারাদিনে যে অজস্র ফাইল সই করবেন, তার মধ্যে এই দৌড়বিদদের কারো কোনো ফাইল থাকা বিচিত্র কিছু নয়। 

উপাচার্য হয়তো অফিসে যাচ্ছেন, তিনি তার ওই চেয়ারে বসার আগেই ৩০ জন হয়তো ‘সালাম’ জানাতে চলে এসেছেন অপেক্ষাগৃহে। ভিসি হয়তো নশ্বর চোখে খলিফা হারুন অর রশীদের মতো, ভর্তি পরীক্ষার হল পরিদর্শন করতে গেছেন। আশপাশে ডানে-বামে যে ১৮ জন গিজগিজ করছেন, এদের পদমর্যাদা আর ভ্রমণকর্তব্য কী এই বিষয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতেই ভর্তি পরীক্ষার্থীদের হয়তো দুইটা কম্পুটার গোল্লা মারা মিস হয়ে গেল। এই তালিকা আমার শুরু করা ঠিক হবে না। 

কেউ কেউ মনে করেছেন, আগের মতো নির্বাচনে ভিসি হলেই ভাল হতো। ‘গণতন্ত্র ফিরে আসতো।’ এসব নির্বাচনবাজ গণতন্ত্রপন্থীদের আমি দূর থেকে সালাম জানাই। আমি একদা জাকসু-বিজয়ী বলে জাকসু নির্বাচন নিয়েও অনেক খোঁচাখুঁচি করেন লোকজন। নির্বাচনকে ধন্বন্তরী ধরে কোনো আলাপ লম্বা করব না। বরং, জানাই যে জাহাঙ্গীরনগরে ভিসি নিয়োগের মতো এখন ডিন ইত্যাদিও আরামসে এক কলমের খোঁচায় নিয়োগ হয়ে যাচ্ছে। সবাই সুখে-শান্তিতে অফিস করছেন।        

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন এমন লোকজন মাঝে মধ্যে খোঁজ নেন ‘তা আপনাদের অবস্থা এখন ভাল তো?’ আমারও অনেকের মতোই কর্তব্যবোধ হয়, বলি, ‘জ্বি, জ্বি সব ঠিকঠাক আছে।’ এই প্রশ্নকারীর একদল আবার এখানেই থামেন না। তারা আলাপ এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাতে বলে বসেন, ‘তো আপনাদের উপাচার্য তো মনে হয় ভালই।’ এরকম বলার পর খুব প্যাঁচ লেগে যায়। মানুষকে ভাল বা মন্দ রায় দিতে খুবই অপারগ লোক আমি। তাছাড়া লোকের ব্যক্তি-ভালত্ব বুঝবই বা কী দিয়ে! প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতির বাইরে তো কিছু নেই আমাদের হাতে। 

তাছাড়া, একটু পরেই মনে হয় আসলে প্রশ্নকারী বলতে চেয়েছেন, ‘গদি-টদি নিয়ে তার টানাটানি নেই তো?’ এই প্রশ্নটি পেটের মধ্যে অস্পষ্ট থাকে বলেই হয়তো ওই প্রশ্নটি করেন। গদি টানাটানির বিষয়টা বর্তমান বাংলাদেশে বেশ জটিল। সেই প্রসঙ্গে তখন আলাপ করার জন্য গলা নিশপিশ করতে থাকে। কিন্তু তখন একটা লম্বা আলাপ মোটেই সুখকর থাকে না। একটা মৃদু প্রায় বোকাবোকা হাসি দিয়ে শেষ করতে হয় আলাপ। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের গদির স্থায়িত্ব সম্বন্ধে বুঝতে গেলে প্রথমেই আপনার মহাভারতের কুরুক্ষেত্র অধ্যায়টি বুঝে নিলে ভাল। অন্তত বিদ্যমান বাংলাদেশে। তবে মহাভারত জটিল ও দীর্ঘ মনে হলে, আপাতত গ্রামতুতো একটা চুটকি-গল্প দিয়েও কাজ চালানো যাবে।

ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ধরে-বেঁধে আনা এক ভোটার ভোট দিতে যাওয়ার আগে প্রার্থীর উঠানে বসেছেন। প্রার্থী হুকুম দিলেন ‘পানি এনে খাওয়া’। বলার সময় একটু থুতনি দিয়ে বাড়তি ভঙ্গি করে দিয়েছেন। যারা ভোটার নিয়ে এসেছেন, প্রার্থীর লোকজন, তারা তাকে বোতল ধরিয়ে দিলেন। কোমল পানীয়ের বোতল। বোতল খুলল, ফুস করে আওয়াজ হলো, তিনি ওই মিঠা পানি খেয়ে গেলেন ভোট দিতে। ভোট শেষেও তিনি প্রার্থীর উঠানে গেলেন। পানি চাইলেন। প্রার্থী এবারও পানির হুকুম দিলেন। এবারও কেউ বোতল নিয়ে এলেন। সেই বোতল খুলতে গিয়ে আর ফুস আওয়াজ উঠল না। তিনি বিস্বাদ মিঠাহীন পানি বেজার মুখে খেলেন। তারপর নিতান্ত অশান্তিতে প্রার্থীকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘পানি তো দুইবারই আপনিই বললেন। একবার ফুসওয়ালা পানি আসলো, আরেকবার সাদা পানি, স্যার ঘটনাটা কী?’ প্রার্থী সৎ বটেন। তিনি বললেন, ‘আগের বার পানি বলার সাথে সাথে ঘেডি কাইত করে দিছিলাম। তুমি দ্যাখো নাই। হেরা দেখছে।’

এখন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া এক বস্তু; আর নিয়োগের সময়ে থুতনি বা ঘেডি কাত করে দেওয়া আরেক বস্তু। ক্যাম্পাসগুলোতে পদলোভীর (নিন্দুকরা আড়ালে হয়তো পদলেহীও বলেন) সংখ্যা বিপুল। তারা সবাই দিবারাত্র এই শাসনব্যবস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত। এত ভক্ত যে আগে যদি অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রীরও ভক্ত থেকে থাকেন, তাও নিজে ভুলে গেছেন। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী তার অগণিত, রাশি রাশি, ভক্তদের মধ্য থেকেই অন্য ভক্তদের অসীম ব্যাজারমুখের মধ্যে একজনকে উপাচার্য বানিয়ে দেন। আচার্যকেও অকর্মণ্য কিংবা নির্লিপ্ত ভাবা ঠিক হবে না। তিনি অবশ্যই তা অবলোকন করেন; এবং অতি অবশ্যই নিয়োগপত্রে সই করেন। তো দিলেন! এরপর অন্য অগণিত না-ভিসি ভক্তদের সাথে উপাচার্যের চেয়ারের সম্পর্কটা কী হবে সেটা কিন্তু ওই ‘ঘেডি কাতে’র মধ্যেই নিহিত আছে। ‘কোনো হইচই য্যান না দেখি’ – এটা একটা ঘেডিকাত। সুনির্দিষ্ট এসার্টিভ ভঙ্গি। ঘেডি হোক, থুতনি হোক, আর একান্ত ঘটক/ব্রোকারদের মাধ্যমে হোক। এই পদ্ধতির নিয়োগদানের পর রাশিরাশি গাদাগাদা যে না-ভিসি শিক্ষকনেতারা ক্যাম্পাসে জীবিত ও কার্যকর আছেন তারা কিলবিল করে চেয়ারের পাশে ঘুরঘুর করতে থাকবেন। অন্তত অনেকদিন। 

আরেকটা হলো নির্লিপ্ত ভঙ্গির নিয়োগ – ‘হইছেন তো, এখন চালান।’ এই পদ্ধতির নিয়োগের পরও ওই কিলবিল শিক্ষকেরা ঘুরঘুর করবেন, কিন্তু প্রায়শই চেয়ারের উপর দংশনপ্রচেষ্টাসমেত। যারা আমার থেকে ভাল ক্রিটিক্যাল ইতিহাসবিদ, তারা সম্ভবত দেখাতে সমর্থ হবেন যে, জাহাঙ্গীরনগরের বর্তমান ভিসি এখানে উল্লিখিত প্রথম পদ্ধতির নিয়োগের উদাহরণ। আর ঠিক সাবেক ভিসি হলেন পরের নির্লিপ্ত পদ্ধতির নিয়োগকৃত ভিসি। আনোয়ার স্যারকে আমার এই প্রস্তাবনার বিষয়ে সাহস করে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি। 

ফলে ভিসিবিরোধী তৎপরতা অত সোজাসাপ্টা বিষয় নেই আর। তা ‘বিপ্লবী’ শিক্ষার্থীরা করুন, আর বিপদাপন্ন কলিগেরা করুন, আর বিদগ্ধ ভিসিপদকামীরা করুন। ভিসিও কোনো সোজাসাপ্টা পদ নয়। একেক ভিসির একেক দক্ষতা। যদি কোনো ভিসি নর্তনে সমর্থ হয়ে থাকেন, তো আরেক ভিসি আশুলিয়া অফিসের গোয়েন্দাকে কিংবা কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতাকে হয়তো দৌড়ানি দিতে সক্ষম।

আবার দেখুন, শাবিপ্রবির ভিসি। আন্দোলনে মামুলি চাঁদা যাতে না-দিতে পারে সমর্থকেরা তার জন্য ডিজিটাল মুদ্রা কোম্পানির ট্রানস্যাকশন পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পেরেছেন। যা-তা কাজ নয়। অনেক সামরিক অফিসার পর্যন্ত তাকে এই বিদ্যাতে হিংসা করতে পারবেন। কেবল তাই নয়, এই রচনা লেখার আগেই পাঁচজন সাবেক শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছেন শিক্ষার্থীদের চাঁদা দেওয়ার ‘অভিযোগে’। এরকম বিচিত্র কারণে এর আগে কেউ গ্রেফতার হয়েছেন কিনা বাংলাদেশে জানা যায়নি। তবে আগামীতে প্রতিপক্ষতা সামলাতে এই টর্চার-আউটলেট কেবল ব্যবহারের যে চেষ্টা হবে তাতে কোনো সন্দেহ দেখি না। শাবিপ্রবির উপাচার্য এই জাতির অভূতপূর্ব আউটলেটের জনক হয়ে থাকবেন।

আমি উপাচার্যদের আন্ডারস্টিমেট করার ঘোরতর বিপক্ষে। এরা আচার্যকে পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র বানিয়ে ছেড়েছেন!

ড. মানস চৌধুরী ।। অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়