ওরা দু’জন গোটা বাংলাদেশের প্রতিনিধি
গ্যালারিতে বাংলাদেশের দুই সমর্থক শোয়েব ও রবি/ছবি: ঢাকা পোস্ট
উপমহাদেশে ক্রিকেট মানেই যেন বাড়তি আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা আর রোমাঞ্চ। জনপ্রিয়তার বিচারে বাকিদের থেকে এগিয়ে অবস্থান বাংলাদেশি সমর্থকদের। এদেশে ক্রিকেট মানে হাজার কর্মযজ্ঞ সরিয়ে উৎসবের আবহ তৈরি, মাঠে যে লড়ছে প্রিয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা। তাদের সমর্থনে বাধ সাধে কোন ব্যস্ততা? এই একখানে এসেই মেলে অবিভক্ত এক জাতীর দেখা। সব ভেদাভেদ ভুলে সবার একটাই স্লোগান- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ! অথচ করোনা ভেস্তে দিয়েছে সকল আয়োজন। টাইগাররা লড়ছে মাঠে, বিশাল গ্যালারিতে কেবলই ওরা দুজন।
অদৃশ্য এক মহামারিতে বিধ্বস্ত গোটা পৃথিবী। এলোমেলো করে দিয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাপন। ক্রিকেটও তো এর বাইরে নয়। মার্চের পর প্রায় চার মাস বন্ধ থাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। এরপর গত জুলাই মাসে আবার শুরু হয়েছে মাঠের লড়াই। কিন্তু যারা এই লড়াইয়ে বাড়তি উন্মাদনার মাত্রা যোগ করবে, সেই সমর্থকরা কোথায়? বলা হয়ে থাকে দর্শক খেলাধুলার প্রাণ। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এটি আরো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্যালারিতে বসে সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের খেলা দেখতে সমর্থকদের বিসর্জন তো ইতিহাসের পাতা ভারি করেছে। সে গল্পও অজানা নয়।
বিজ্ঞাপন
করোনা নিষ্প্রাণ করেছে ক্রিকেটকে, সমর্থকদের। মাঠে খেলা ফিরলেও গ্যালারিতে নেই সেই উত্তাপ। যেখানে স্টেডিয়ামে বসে প্রিয় দলের খেলা দেখতে রীতিমতো যুদ্ধে জড়াতেন সমর্থকরা, সেখানে কোভিড-১৯ এর জেরে নিস্তব্ধ পড়ে থাকে গোটা গ্যালারি। রঙহীন, বিবর্ণ। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে সীমিত দর্শক ফিরলেও গোটা চিত্র একই।
মার্চে জিম্বাবুয়েকে আতিথেয়তা দেওয়ার পর করোনার কারণে বন্ধ থাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট। এরপর বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের মতো ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আসর মাঠে গড়ালেও গ্যালারিতে দর্শক ফেরায়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এর কারণ তারা পরিস্কার করেছে অনেকবার, দর্শক ফিরিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না টাইগার বোর্ড। প্রতিষেধক না আসা পর্যন্ত ফাঁকাই পড়ে থাকবে গ্যালারির আসন। একই কারণে চলমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও সমর্থকদের মাঠে আসার সুযোগ দেয়নি বিসিবি।
বিজ্ঞাপন
উইন্ডিজের বিপক্ষে ৩ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের পর ২ ম্যাচের টেস্ট। সাদা পোশাকের সিরিজের প্রথম ম্যাচে চট্টগ্রামে মুখোমুখি হয়েছে দু'দল। তবে সেখানেও নেই দর্শক উপস্থিতি। তবে গ্যালারিতে উড়ছে দুটি লাল-সবুজের পতাকা। ডোরাকাটা পোশাকে টাইগার সাজে দুজন ওড়াচ্ছেন পতাকা দুটি। বারবার মুখ দুটি ভেসে আসছে টেলিভিশন পর্দায়। স্বাগতিক দলকে উজ্জীবিত করছেন দুজন, সাকিব-তামিমদের সঙ্গে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ চিৎকারে মাতাচ্ছেন গোটা স্টেডিয়াম। দুজনের একজন বাংলাদেশ দলের আইকনিক ফ্যান- শোয়েব আলী, আরেকজন রবিউল ইসলাম রবি।
বেশ আক্ষেপ নিয়েই দুজন শোনালেন তাদের গল্প। সাগকরিকার পাড়ে ম্যাচের দ্বিতীয় দিন চা-বিরতিতে শোয়েবের কণ্ঠটা বেশ মলিনই শোনাল।
এখন গ্যালারিতে কেউ না থাকায় মনে হয় যেন বিদেশে খেলা দেখছি। আমি জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কাতে যেমন দেখেছিলাম গ্যালারিতে, কেউ ছিল না, সে রকম লাগে। একা একা চিৎকার করা সেই একই অনুভূতি। দেশে দর্শক হলো খেলার মূল। দর্শকদের সঙ্গে যে আনন্দটা করি, সেইটা গ্যালারিতে আসার আসল কারণ। অমি যখন বলি– তোমার দেশ, আমার দেশ; আর গ্যালারীর সবাই বলে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। তখন শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। আমি এখন সেই অনুভূতিটা খুব মিস করছি।
শোয়েব আলী, সমর্থক, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল
রবির কথাতেও বাজল একই সুর, ‘মানুষ ভরা গ্যালারীতেই খেলা দেখতে ভাল লাগে।’ মাঠে দর্শক না ফেরালেও শোয়েবের জন্য নিয়মে শিথিলতা এনেছে বিসিবি। এজন্য টাইগার বোর্ডের কাছে কৃতজ্ঞ এই সমর্থক। তবে শোয়েবের মতো ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি পাকিস্তানের আইকনিক সমর্থক চৌধুরী আব্দুল জলিলের। ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছে পাকিস্তান, সেখানে গ্যালারিতে বসার সুযোগ পাননি জলিল। সুযোগ মেলেনি ভারতীয় আইকনিক সমর্থক সুধীর গৌতমেরও।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ শুরু হয়েছে ভারতের। সেখানে থাকতে পারবেন না তিনি। গ্যালারিতে বসার আবেদন জানাতে সুধীর অবশ্য ছুটে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি সৌরভ গাঙ্গুলির কলকাতার বাসায়। তবে তিনি যেদিন সৌরভের সঙ্গে দেখা করেত যান, সেদিনই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন সৌরভ। হাসপাতাল গেটে প্রতিদিন দেশের পতাকা হাতে সৌরভের সুস্থতায় প্রার্থনা করেছেন সুধীর। তবে সাক্ষাতের অনুমতি মেলেনি।
এই প্রতিবেদককে শোয়েব বলেন, ‘বুধবার পাকিস্তানের জলিল চাচা আমাকে বার্তা পাঠাল যে দেশের মাঠে খেলা দেখতে পারছেন না। উনার খেলা দেখার বয়স ৩০-৪০ বছর, অথচ তিনি সুপার ফ্যান হওয়ার পরও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা দেখতে পারছেন না। আবার ভারতের সুধীর, সে বোর্ড থেকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দেখার অনুমতি পাচ্ছে না। ওর ২০ বছরের ক্যারিয়ারে দেশের খেলা মিস করেনি। অথচ সেও ঢুকতে পারছে না। সেখানে বিসিবি আমাকে খেলা দেখার অনুমতি দিয়েছে। এরজন্য আমি বিসিবির কাছে খুব কৃতজ্ঞ।’
রবি আমন্ত্রণপত্র পেয়েছেন তার প্রিয় ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের কাছ থেকে। তিনি জানালেন ‘আমাকে বোর্ডের কয়েকজন বিনা টিকিটে খেলা দেখতে বলেছিল। কিন্তু আমি বিনা টিকিটে খেলা দেখতে চাই না। মুশফিক ভাই টিকিট দিলে বা সুযোগ করে দিলেই খেলা দেখি, নয়ত দেখি না।’
টিআইএস/এনইউ/এটি