ঘড়ির কাটায় তখন দুপুর ১টা। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) করোনা ইউনিটের সামনে একসঙ্গে এসে থামল তিনটি অ্যাম্বুলেন্স। একটি সরকারি, অপর দুটি বেসরকারি।

বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক রফিকুল ইসলাম জানান, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলা থেকে এসেছি। রোববার (৪ জুলাই) সন্ধ্যা থেকে সোমবার (৫ জুলাই) দুপুরের মধ্যে তিনবার এসেছি এই হাসপাতালে।

রোগী সালেহা বেগমের পুত্রবধূ মিনারা জানান, শাশুড়ির অস্বাভাবিকভাবে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় এসেছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর ট্রলি পান মিনারার স্বামী ইউসুফ। তিনি জানান, রোগীর চাপ থাকায় কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।

অন্য অ্যাম্বুলেন্সটি নাজিরপুর থেকে এসেছে। তারা ট্রলি পেয়ে গেছেন। রোগীর স্বজন জানান, ওয়ার্ডে ঢুকে ট্রলিবয়কে দেড়শ’ টাকা দিয়েছেন। ট্রলি ম্যানেজ হয়ে গেছে তাদের।

ততক্ষণে রিকশায় আরও দুজন রোগী চলে এসেছে প্রধান ফটকে। দায়িত্বরত আনসার সদস্য সাগর বলেন, গত দুই দিন রোগীর চাপ বেড়েছে। সকাল থেকে তিনজনের লাশ নেমেছে। পরিস্থিতি উদ্বেগের।

নিচতলায় ৭ জন নার্স ট্রলিভর্তি ট্যাবলেট নিয়ে ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আলাপ করার চেষ্টা করা হলে বলেন, ওয়ার্ডে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার আগে কথা বলার ফুরসত নেই।

করোনায় আক্রান্ত রোগী হাওয়া বেগম বলেন, সকালে নাম কেটে দিয়েছে। করোনা নেগেটিভ না হলেও কেন নাম কেটে দিয়েছে তা জানেন না। মঙ্গলবার (৬ জুলাই) এসে পরীক্ষা করাতে বলেছে। তিনি বলেন, ৩/৪ দিন পরে একবার ডাক্তার এসে রোগী দেখেন। আর সব সময়ে নার্সরাই রোগীদের পাশে থাকেন। ভোলার ভেলুমিয়া লঞ্চঘাটসংলগ্ন তাদের বাড়ি।

করোনা ইউনিটের ‘হাঁচি-কাশি’ ওয়ার্ডে থরথর করে কাঁপছিলেন পটুয়াখালীর পাটখালী গ্রামের হালিম বিশ্বাস। তিনি বলেন, শ্বাসকষ্ট না থাকলেও কিডনিতে সম্যসা ও ডায়াবেটিস আছে তার। সকালে অনেক কষ্ট করে বরিশাল এসেছেন। পরীক্ষা ছাড়া ভর্তি নেবে না বলে জানানো হয়েছে তাদের।

দোতলায় যাওয়ার জন্য লিফটের সামনে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ জন মানুষ অপেক্ষায় রয়েছেন। ঠেলাঠেলি করে লিফটে যাতায়াত করছেন তারা। রোগীর স্বজন মৃনাল বলেন, সকাল থেকেই দুটি লিফটের একটি বন্ধ। ওদিকে ওঠানামার সিঁড়িতে টাইলস বসানো হচ্ছে। ফলে যাতায়াতের এই একটি লিফট ভরসা।

তিনি আরও বলেন, করোনা ইউনিটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না কেউ। নার্স ও ডাক্তাররা আন্তরিক। তবে করোনা ইউনিটের পরিবেশ একেবারে থাকার অনুপযোগী। সারা দিনে একবার পরিষ্কার করা হয়। ফলে ময়লা-আবর্জনা, রোগীর খাবার, পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস যেখানে সেখানে ফেলে রাখা। এতে করে রোগীর সঙ্গে যারা আসেন তারাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন।

দোতলায় করোনা পজিটিভ ওয়ার্ডে দেখা গেল দরজার সামনেই মাস্ক, সিগারেটের অবশিষ্টাংশ, ফেলে রাখা হয়েছে। কেবিনের সামনে পিপিই ও বিছানার চাদর। মেঝেতে ধুলো-বালির অন্ত নেই। নারীদের জন্য নির্ধারিত টয়লেটের কাছেই রোগীরা শুয়ে আছেন। টয়লেটের সামনে রোগীদের ফেলে দেওয়া ভাত, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, কোমল পানীয়ের বোতলের স্তূপ।

ঢুকতে গিয়েই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন শাহিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘আইলাম করোনা রোগীর লগে। কতো রোগ শরীলে বান্ধাইয়া লইয়া যাই, কইতে পারি না।’

দ্বিতীয় তলার জেনারেল ওয়ার্ডে বেড ও মেঝেতে রোগী ঠাসা। একজন ওয়ার্ডবয় খুঁজচ্ছিলেন অমি। তিনি বলেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানোতে সমস্যা হয়েছে। এর সমাধানের জন্য দেড়শ টাকা চেয়েছিল এক ওয়ার্ডবয়। আমি দেইনি। তারপর থেকে আর কাউকে বললেও শুনছে না।

তৃতীয় তলায় একটিমাত্র টয়লেট। ফলে ঠেলাঠেলি এবং দীর্ঘ সময় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেখানে হুইল চেয়ারে অপেক্ষমাণ করোনা রোগীর স্বজন সাইফুল বলেন, একটি তলার সব রোগী ও স্বজনদের জন্য মাত্র তিনটি টয়লেট রয়েছে। তাও ঠিকমত পরিষ্কার করা হয় না।

চতুর্থ তলায় কথা হয় বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, দিনে একবার পরিষ্কার করা হয়। এভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা কেন্দ্র পরিচ্ছন্ন করা হলে চলে না। তাছাড়া ওয়ার্ডবয়রা টাকা ছাড়া কোনো সেবা দেন না। চতুর্থ তলার করোনা ওয়ার্ডের সবগুলো বেডে করোনা রোগী রয়েছেন।

ওই তলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী আলতাফ হাওলাদার বলেন, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় দশজনের কাজ একজনকে করতে হয়। হাসপাতালের অন্য ওয়ার্ডের কেউ করোনা ওয়ার্ডে ডিউটি করতে চান না।

পঞ্চম তলায়ও রোগী ভর্তি করা শুরু হয়েছে আজ। পঞ্চম তলায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও অপরিষ্কার ওয়ার্ডে বেড রাখা হয়েছে রোগী নিয়ে আসার জন্য। মূলত ২০২০ সালের ১৭ মার্চ করোনা ইউনিট চালু হলেও প্রথম রোগী ভর্তি হয় ওই বছরের ৮ এপ্রিল। শুরুতে ৫০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন ২শ’ শয্যাায় উন্নীত করা হয়েছে।

এই ইউনেিট নেই নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক, নার্স বা তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির জনবল। জানা গেছে, মাত্র দুজন চিকিৎসক দুই শতাধিক রোগীকে সেবা দেন। আর ৪৫ জন নার্স দায়িত্বে রয়েছেন। ২২টি আইসিইউ এবং ১২টি ভেন্টিলেটর আছে। আইসিইউ ও ভেল্টিলেটর নিয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক এইচএম সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৯৬৮ সালে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময়ে জনবল ছিল সাড়ে তিনশ। এরপর হাসপাতাল ৫০০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু জনবল বাড়েনি। তারপর ১০০০ বেডে হাসপাতাল উন্নীত করা হলেও একজনও জনবল বাড়েনি।

তিনি আরও বলেন, এখনো কিন্তু সেই সাড়ে তিনশ’ জনবল দিয়ে সেবা দিচ্ছি। তাছাড়া করোনাকালীন রোগীর চাপ বেশি থাকায় হিমশিম খেতে হয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি যা আছে তা দিয়ে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে।

এমএসআর