বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করছেন এক মৌয়াল

মানিকগঞ্জের কৃষিজমিজুড়ে এখন হলুদের সমারোহ। অল্প পুঁজিতে বেশি লাভ হওয়ায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন মানিকগঞ্জের কৃষকরা। সরিষাখেতে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৌয়ালরা। অনুকূল আবহাওয়া থাকলে এ বছর মানিকগঞ্জের মৌয়ালদের মধু আহরণের লক্ষ্য প্রায় ৬০ মেট্রিক টন।

মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলাতেই আবাদ হয়েছে সরিষা। তবে শিবালয়, ঘিওর, হরিরামপুর, সিংগাইর ও সদর উপজেলায় সরিষার আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর এবং ঈশ্বরদী এলাকা থেকে আসা তিন শতাধিক মৌয়াল সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন।

চলতি মৌসুমে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব সরিষাখেতের পাশে ৬ হাজার ১৪০টি বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত রয়েছেন তিন শতাধিক মৌয়াল। তবে গত বছরের তুলনায় এবার মুধর উৎপাদন বেশি হবে।

সরেজমিন মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জানা যায়, সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সে এনে জমা করে মৌমাছিরা। এভাবে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত করে তারা। প্রতিটি বাক্সে রয়েছে একটি করে রানি মৌমাছি। সে মধু আহরণে সরিষাখেতে না গেলেও কাজ করে বংশবিস্তারে। আর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে কর্মী মৌমাছিরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে সপ্তাহে এক থেকে দুবার এসব বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালরা।

জানা যায়, স্থানীয় ও পাইকারি বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এসব মধুর। মাঠপর্যায়ের মৌয়ালদের থেকে ডাবর, এপি, ট্রপিকা, বিটি কনজ্যুমার আঞ্জুমা কোম্পানির লোকজন পাইকারি দামে মৌয়ালদের কাছ থেকে মধু কেনেন। খুচরা বাজারে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকায় মধু বিক্রি করলেও পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি। তবে চাহিদার ওপর নির্ভর করে ওঠানামা করে মধুর বাজারদর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব সরিষাখেতের পাশে ৬ হাজার ১৪০টি বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত রয়েছেন তিন শতাধিক মৌয়াল। তবে গত বছরের তুলনায় এবার মুধর উৎপাদন বেশি হবে। একাধিক মৌয়াল জানান, প্রায় ৬০ মেট্রিক টন মধু উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকার মতো।

সরিষা ফুল থেকে মধু আহরণ করছে মৌমাছি

ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুড়ি এলাকায় একটি সরিষাখেতের পাশে অস্থায়ীভাবে ২০০টি বাক্স বসিয়েছেন মৌয়াল বাদশা মিয়া। তিনি বলেন, আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে মধু সংগ্রহের পরিমাণ কমবেশি হয়। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দুবার এসব বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়। প্রতিটি বাক্স থেকে সপ্তাহে ৫ থেকে ৬ কেজি মধু আহরণ করা যায়।

তবে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে ১০ থেকে ১২ দিন পরপর বাক্স থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে সরিষা ফুল থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মধু সংগ্রহ করা যাবে বলে জানান তিনি।

সদর উপজেলার মুলজান এলাকায় মধু সংগ্রহকারী মৌয়াল সেলিম রেজা বাবলু বলেন, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার কুশুলিয়া গ্রাম থেকে প্রতিবছর মধু সংগ্রহের জন্য মৌমাছির বাক্স নিয়ে আসেন মানিকগঞ্জে। এবার ১৫০টি মৌমাছির বাক্স থেকে ৬০ থেকে ৭০ মণ মধু আহরণ করতে পারবেন তিনি, যার বাজারমূল্য সাড়ে ৯ লাখ থেকে ১১ লাখ টাকা।

তিনি আরও জানান, এ পর্যন্ত ১৫ মণ মধু আহরণ করে স্থানীয়সহ পাইকারি বাজারে প্রায় আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। এ বছর মানিকগঞ্জ থেকে সব মৌয়াল মিলে প্রায় ৬০ মেট্রিক টন মধু আহরণ করবেন, যার বাজারমূল্য আড়াই কোটি টাকার মতো।

গত মৌসুমে জেলায় ৩৬ হাজারের কিছু বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার হেক্টর জমি। গত বছর বছরে সরিষা ফুল থেকে সাড়ে সাত হাজার বাক্স দিয়ে ৩২ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করেছিলেন মৌয়ালরা।

মো. শাহজাহান আলী, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

মৌয়াল ফয়সাল বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মধু সংগ্রহের ব্যবসায় মুনাফা পাওয়া গেলেও আবহাওয়া প্রতিকূলে থাকলে ব্যবসায় লোকসান গুনতে হয়। তবে সরকারিভাবে মধুর বাজারদর নিয়ন্ত্রণ ও বিদেশে মধু রপ্তানি করা গেলে মধু ব্যবসায় মুনাফা আরও বাড়বে।

মধু সংগ্রহ করার জন্য রানি মৌমাছিসহ প্রতিটি বাক্স কিনতে ব্যয় হয় প্রায় আড়াই হাজার টাকা, এমনটা জানিয়ে ফয়সাল বলেন, সরিষা ফুল থেকে মৌসুমের মানিকগঞ্জে চার থেকে পাঁচ মাস মধু সংগ্রহ করা যায়। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ধনিয়া ও কালোজিরা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়। এরপর লিচুর মৌসুমে ঈশ্বরদী থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়। এ বছর প্রায় ২০ লাখ টাকার মধু বিক্রি করার টার্গেট করেছেন মৌয়াল ফয়সাল।

মৌচাষে লাভবান হওয়া যায় বলে লেখাপড়া পাশাপাশি মৌচাষ সম্পর্কে জানতে মানিকগঞ্জে এক মৌয়ালের সঙ্গে মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মো. রেজোয়ান হোসেন রাজু। আলাপকালে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় আমাদের পড়াশোনার তেমন চাপ নেই। বাড়িতে অলস সময় না কাটিয়ে মৌচাষ সম্পর্কে হাতেখড়ি জ্ঞান অর্জন করছি মৌয়াল সেলিম ভাইয়ে কাছ থেকে। তা ছাড়া আমাদের প্রাধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন করোনাকালীন যেহেতু স্কুল-কলেজ বন্ধ, অতএব এই সময়ে হাতের কাজ শেখা উচিত। এ জন্য মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিতে আসা হয়েছে বলে জানান এই তরুণ শিক্ষার্থী।

রাজুর মতো মৌচাষ শেখার জন্য একই এলাকা থেকে আরেক শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলামও এসেছেন মানিকগঞ্জে। তিনি বলেন, বাড়িতে বসে থেকে কোনো কাজ শেখা যায় না। তাই মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। এটা অবশ্যই ভবিষ্যতে আমার কাজে লাগবে বলে জানান তিনি।

মানিকগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শাহজাহান আলী বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে জানান, গত মৌসুমে জেলায় ৩৬ হাজারের কিছু বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার হেক্টর জমি। গত বছর বছরে সরিষা ফুল থেকে সাড়ে সাত হাজার বাক্স দিয়ে ৩২ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করেছিলেন মৌয়ালরা।

এবার আহরণের পরিমাণ আরও বাড়বে। তবে কৃষি অফিসে মধু আহরণের কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। সরিষা ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহের ফলে পরাগায়নের মাধ্যমে সরিষার ফলন বাড়ে বলে জানান তিনি।

এনএ