লাল মাটিতে স্বপ্ন দেখছেন পানচাষিরা
লাল মাটির পানে কৃষক আশা দেখছেন
রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের আওতাধীন বরেন্দ্র ভূমিখ্যাত রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এই বরেন্দ্র নামকরণের পেছনেও রয়েছে একাধিক পৌরাণিক কাহিনি। ‘বর’ অর্থ আশীর্বাদ এবং ‘ইন্দ্র’ অর্থ দেবতাদের রাজা। এককথায় দেবরাজ ইন্দ্রের আশীর্বাদ রয়েছে এই অঞ্চলে।
পদ্মা-মহানন্দা-করোতোয়া নদীবেষ্টিত বরেন্দ্র ভূমির অবস্থান গ্রীষ্মপ্রধান মৌসুমি মণ্ডলে। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু এই অঞ্চল কৃষিকে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। প্রকৃতি এখানে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে বরেন্দ্রজুড়েই।
বিজ্ঞাপন
শীতকালে প্রচণ্ড শৈত, গ্রীষ্মকালে প্রখর তাপমাত্রা এবং অনাবৃষ্টি অতিবৃষ্টি মোকাবিলা করে ফসল ফলাতে হচ্ছে কৃষকদের। জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিত্য বদলে যাচ্ছে চাষবাদের ধরন। হেরে গিয়ে কখনো কখনো পথে বসছেন কৃষক।
এই অঞ্চলের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে পান একটি। কৃষকের কাছে এটি কাঁচা সোনা। প্রতিদিন পানপাতা তুলে বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পাচ্ছেন চাষি। তবে এখানেও দুর্যোগ পিছু ছাড়ছে না চাষিদের। গেল বর্ষা দীর্ঘায়িত হয়েছে বরেন্দ্রেজুড়ে। ভারী বর্ষণে তিন দফা বন্যা হানা দিয়েছে এই অঞ্চলে। মাঠের ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন পানচাষিরা।
বিজ্ঞাপন
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর জানাচ্ছে, গেল বছরের প্রথম দফা বন্যায় মাত্র দুই হেক্টর পানবজর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ ৩৯ লাখ। বন্যা এখানেই শেষ হলে ক্ষতি কোনো রকমে পুষিয়ে নিতেন চাষি। কিন্তু প্রথম দফা বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই হানা দেয় দ্বিতীয় দফা বন্যা। এতে নতুন করে তলিয়ে যায় আরও ৪৩ দশমিক ২৫ হেক্টর পানবরজ। এতে আরও ৮ কোটি ৪৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয় চাষিদের। তৃতীয় দফা বন্যায় আরও ২৫ হেক্টর পানবরজ তলিয়ে যাওয়ায় ক্ষতি হয়েছে ৪ কোটি ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
তবে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৌশল বাতলেছেন পান চাষের সমৃদ্ধ রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার রইপাড়া এলাকার চাষি মোহাম্মদ জনাব। জেলার দুর্গাপর উপজেলায় কয়েক প্রজন্ম ধরে পান চাষ করে আসছেন তিনি। দুই বছর ধরে তিনি ঠা-ঠা বরেন্দ্র ভূমি রাজশাহীর কাঁকনহাটে গড়ে তুলেছেন পানবরজ।
সরেজমিন পানবরজেই পাওয়া গেল চাষি মোহাম্মদ জনাবকে। তিনি ভাই ও ছেলেকে নিয়ে পানপাতা সাজাচ্ছিলেন। বরেন্দ্র এলাকায় একমাত্র পানচাষিও তিনি। কঠিন মাটিতে পানচাষ শুরুর গল্প শুনিয়েছেন অদম্য এই চাষি। তিনি বলেন, পেয়ারা চাষের জন্য দুই বিঘা জমি লিজ নিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়ার লাভ করতে পারেননি। তার বাবা পানচাষি ছিলেন। তিনিও পান চাষে যুক্ত বহুকাল থেকেই। তার প্রশ্ন ছিল, এই মাটিতে অন্যান্য ফসল হলে, পান কেন নয়?
বছর দুয়েক আগে মোহাম্মদ জনাব নেমে পড়েন পান চাষে। ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে তৈরি করেন বরজ। ছয় মাস ধরে পানপাতা সংগ্রহ করছেন। নতুন বরজ, প্রতি সপ্তাহে এখন ১ হাজার ২০০ টাকার পান উঠছে। এক বছর পর এই আয় বাড়বে অন্তত পাঁচ গুণ।
মোহাম্মদ জনাব বলেন, বরেন্দ্র এলাকার লোকজন পানবরজের কাজ জানেন না। তাই বাইরে থেকে কর্মী আনতে হচ্ছে। অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বরজে কাজ করছেন। তা ছাড়া খুচরা বাজার থাকলেও পানের স্থানীয় পাইকারি বাজার নেই। ফলে পানপাতা সংগ্রহ করে বিক্রির জন্য দুর্গাপুরের হাটে তুলতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খরচা। কমছে লাভের পরিমাণ।
এই পানচাষির ভাষ্য, বরেন্দ্র এলাকায় পান চাষে বড় প্রতিবন্ধকতা এখানকার মাটির প্রতৃতি। অল্প বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। আবার খরায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এই দুটি পরিস্থিতি পান চাষের জন্য ক্ষতিকর। সংকট কাটাতে বাইরে থেকে মাটি এনে বরজে দিতে হচ্ছে।
নিচের মাটি ফেলে দিয়ে প্রতিবছরেই মাটি তুলছেন বরজে। সেই মাটির ওপর নতুন করে বসাচ্ছেন পানগাছ। এতে বছরে তার অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে অন্তত ২০ হাজার টাকা। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলের পান অন্যান্য অঞ্চলের পানের চেয়ে সুস্বাদু। পাতা বেশ মোটা। বাজারে এই পানের ভালো দাম পাওয়া যায়। প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে মুখে হাসি ফুটবে।
বরেন্দ্রজুড়ে পান চাষের এই সংকটের কথা স্বীকার করেছেন রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শাসছুল হক। তিনি বলেন, পান চাষের জন্য প্রধাণত উঁচু জমি লাগে। পানে লাভ পাওয়ায় কয়েক বছর ধরে চাষি বৃষ্টি হলেও হাঁটুপানি জমে যায় এমন নিঁচু জমিতেও পান চাষ করছেন। এবারের কয়েক দফা বন্যায় জেলার মোহনপুর, দুর্গাপুর ও বাগমারায় বেশ কিছু পানবরজ ডুবে গেছে। এতে পানচাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
তিনি যোগ করেন, পান দাঁড়ানো পানি সইতে পারে না। এই বাস্তবাতায় বরেন্দ্র এলাকায় পান ভালো হবে। সেই ক্ষেত্রে জমিতে প্রাকৃতিক জৈব সার ব্যবহার করতে হবে। তা ছাড়া পান খরা সইতে পারে না। তাই পানির উৎস না থাকলে পান চাষে নামা উচিত হবে না।
রাজশাহী পানের জন্য বিখ্যাত জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, কয়েক বছর ধরেই পান এই অঞ্চলের অন্যতম অর্থকরী ফসল হয়ে উঠেছে। কেবল লাভের আশায় ঢালাওভাবে পান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ নেই। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারিভাবে পান চাষ সম্প্রসারণের পরিকল্পনাও নেই। তবে কৃষক নিজ উদ্যোগে বরেন্দ্র এলাকায় পান চাষ করলে তারা পরামর্শ দেবেন।
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, লাভজন হওয়ায় প্রতিবছরই রাজশাহী অঞ্চলে বাড়ছে পান চাষ। ২০১৬-১৭ কৃষিবর্ষে রাজশাহী জেলায় পান বরজ ছিল ২ হাজার ১৯৬ হেক্টর। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮৪ হেক্টরে। ২০১৮-১৯ কৃষিবর্ষে পান চাষের আওতা বেড়ে দাঁয় ২ হাজার ৮৮৯ হেক্টর। সর্বশেষ ২০১৯-২০ কৃষিবর্ষে রাজশাহীতে ৪ হাজার ৩১১ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছে।
আঞ্চলিক কৃষি দপ্তর আরও জানিয়েছে, রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে সর্বোচ্চ পান চাষ হয় রাজশাহী জেলাতেই। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নাটোর। এ ছাড়া নওগাঁ তৃতীয় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ চতুর্থ। ২০১৯-২০ কৃষিবর্ষে এই জেলায় ৪ হাজার ৩১১ হেক্টর পান বরজে উৎপাদন হয়েছে ৭২ হাজার ৩৩০ টন পানপাতা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পান চাষ হয়েছে নাটোরে ৪২৯ হেক্টর। এই জেলায় পান উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৬৩২ টন। এ ছাড়া নওগাঁয় ৪৫ দশমিক ৩ হেক্টরে ৬৫৭ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ দশমিক ৫ হেক্টরে ১৫ দশমিক ১৯ টন পান উৎপাদন হয়েছে।
এর আগের বছরে এই চার জেলায় পানবরজ ছিল ৩ হাজার ৩৬৭ হেক্টর। সেই পান গত ১৬ দশমিক ৩১ টন হারে ফলন হয় ৫৪ হাজার ৯৩২ টন। ২০১৭-১৮ কৃষিবর্ষে ৩ হাজার ৯৫ হেক্টর বরজে পান উৎপাদন হয়েছে ৫০ হাজার ৬১৯ টন।
এনএ