শিল্পাঞ্চল নামে খ্যাত খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল ও হার্ডবোর্ড মিল বন্ধ হয়ে গেছে বেশ আগে। যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল ছিল তাও সম্প্রতি বন্ধ হওয়ায় খুলনা মহানগরীর খালিশপুর এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন মানুষ। আর এতে মৃতপ্রায় অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে ‘খুলনার শিল্পাঞ্চল’। তবে পাটকলগুলো চালু হবে, এমন আশায় বুক বেঁধে আছেন শ্রমিকরা। 

মিল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সবখানে ফাঁকা। কোথাও কোনো জনমানব নেই। এক সময় মিলের খট খট শব্দ আর শ্রমিকদের পদচারণায় মুখর থাকত যে এলাকা সেখানে বিরাজ করছে ভুতুড়ে পরিবেশ। 

আশপাশে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবাসিক শ্রমিকদের জন্য গোল্ডেন হ্যান্ডসেকের টাকা নেওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল ঘর-বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষকে জায়গাটি বুঝিয়ে দিতে হবে। এ কারণে টাকা পাওয়ার আশায় সবাই নিজেদের ঘরগুলো ভেঙে ট্রাকে করে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে চলে গেছেন। বেশিরভাগই গেছেন গ্রামের বাড়িতে। 

এছাড়া কাজের খোঁজে অন্যান্য শহরেই পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। একেকটি পরিবার চলে যাওয়ার সময় কান্নার রোল পড়ে যেত। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একেকজনকে বিদায় দিতে হয়েছে। এক সময় মানুষের পদচারণায় যেসব এলাকা মুখর থাকতো তা দেখলে মনে হবে বড় কোনো ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

খুলনা ক্রিসেন্ট জুট মিলের প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে শোনা যাচ্ছে ঘর ভাঙার শব্দ। পশ্চিম কলোনির দিকে যেতেই চোখে পড়ে কয়েকজন মিলে শাবল, কোদাল আর হাতুড়ি দিয়ে ১৩ নম্বর ভবনের নিচের একটি পাকা ঘর ভাঙার চেষ্টা করছেন। যার ঘর ভাঙা হচ্ছে তিনি মিলের মেকানিক্যাল বিভাগের শ্রমিক ফিরোজ কবির। 

তিনি ৩৫ বছরের চাকরি জীবনের ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ওই ভবনে বাস করেছেন। হ্যান্ডসেকের টাকা পেতে ঘর ভেঙে কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হবে এ কারণে তা ভাঙছেন। ওই ইট তার নিজের। এ কারণে ইটগুলো খুলে নিয়ে যেতে পারবেন। 

তার গ্রামের বাড়ি ভোলার দৌলতখানে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে সবাই ওই ঘরে বড় হয়েছেন। এখন দুই ছেলে চাকরি করছেন ও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি খালিশপুরের কবির বটতলা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় আছেন। যে টাকা পাওয়া যাবে তা দিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।  

ফিরোজ কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আমি নিজের জিনিস নিয়ে চলে যেতে পারব। সে কারণে আমার ঘর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কোম্পানির কোনো সুতাও আমি নিতে পারব না। 

শ্রমিকদের অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পাঁচ মাস হয়ে গেছে। যাদের ছেলে-মেয়ে একটু বড়, চাকরি করে তারা টিকে আছে। যাদের ছেলে মেয়ে চাকরি করে না তাদের যে কি অবস্থা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বহু লোকের আহাজারি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মিল চালুর চেষ্টা করছেন। কিছু আমলার কারণে, কিছু পরিস্থিতির কারণে মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেল। এই মিল কোনো দিনও বন্ধ হওয়ার কথা না, মিলে লাখ লাখ টাকা লাভ হওয়ার কথা ছিল। 

খুলনা শিপইয়ার্ড লসে লসে জর্জরিত হয়ে গেছিল। নৌবাহিনী দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর এখন কোটি কোটি টাকা লাভ হচ্ছে। এই মিলগুলো একটা দায়িত্ববান লোকের হাতে দিলে এখনও কোটি কোটি টাকা লাভ হবে। যাকে মিল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে তাকেই লাভ-ক্ষতি বুঝিয়ে দিতে হবে। মিলগুলো সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর হাতে দিলে আরও ভাল হয়। এই দুই বাহিনীর হাতে দিলে মিল পানির মতো চলবে। 

ঘর ভাঙার কাজে যারা সহযোগিতা করছিলেন তারাও মিলের শ্রমিক ছিলেন। সেখানে কাজ করা মো. হারুন নামের এক শ্রমিক বলেন, মিল বন্ধ শ্রমিক নেই। চারদিকে হাহাকার। মিল বন্ধ হওয়ায় বদলি শ্রমিক চলে যাওয়ার সময় তাদের ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে কান্না করেছে। 

বদলি শ্রমিকরা টাকা পায়নি, তারা কী অবস্থায় আছে কে জানে? আমরাতো তবুও কিছু পেয়েছি। তার মধ্যে অর্ধেক খরচ হয়েছে। টুকটাক কাজ করবো তার কোনো উপায় নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে আমি ভালো নেই। 

হঠাৎ মিল বন্ধ হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে হারুন বলেন, ধরেন আমার চাকরি আছে ৯ বছর। চাকরির বয়স শেষ হওয়ার এক বছর থাকতে আমি বাড়ি যাব। ঘর-বাড়ি তৈরি করব। তারপর চাকরির বয়স শেষ হলে আমি বাড়ি চলে যাব। এখন তো আর সেটা হলো না। হঠাৎ মিল বন্ধ হয়ে গেছে। যে যেমন পারছে চলে গেছে। 

ক্রিসেন্ট জুট মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন আজাদী বলেন, সরকারের কথা ছিল মিলকে আধুনিকায়ন করে চালু করবেন। পাটমন্ত্রী বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে মিল চালু করা হবে। এটা শোনার পর শ্রমিকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু মিল না খোলায় শ্রমিকরা হতাশ। 

অনেক শ্রমিক বাসা ভাড়া করে অপেক্ষায় আছে মিল কবে চালু হবে, তারা কর্মসংস্থান পাবে। আমরা চাই সরকারি সম্পদ সরকারের হাতে থাকুক। সরকারের হাতে থেকেই মিলটি চালু হোক। 

তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি মালিকের কাছে মিলের দায়িত্ব দেওয়া হলে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো তারা মেশিনারি বিক্রি করে লোন নিয়ে উধাও হয়ে যাবে। 

অত্যন্ত দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয় ২৫টি মিল এক সঙ্গে আধুনিকায়ন করে তারপর আবার শ্রমিকদের কাজের সংস্থান করবে। আজকে সবাই স্বীকার করছে এটা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।

শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের যাদের ২৫ বছর চাকরির মেয়াদ হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি বয়স হয়েছে তাদের যদি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে অবসরে দিত অথবা কেবল যারা অবসরে গেছেন তাদের টাকা আগে দিয়ে দিত, তারপর শ্রমিকদের দিয়ে মিল চালু রেখে আস্তে আস্তে তাদের মজুরিটা দিত, মিল চালু থাকত-তাহলে যে টাকা সরকার এখন দিয়েছে সেই টাকা দিয়ে আগামী ১৫ বছর চলতে পারত। এতে সরকারের কোনো সমস্যা হত না, মিলও সুন্দরভাবে চলতে পারত। 

তিনি আরও বলেন, এই মুহূর্তে চালু করার মতো মিলের মেশিনারির সেই ক্যাপাসিটি আছে। এই ক্যাপাসিটিটা নষ্ট করে এটাকে স্ক্রাবে শেষ পর্যন্ত বিক্রি করা হবে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, এই মুহূর্তে মিল চালু করা হোক। যদি মিল চালু করা হয় তাহলে দেশের মধ্যে পাটপণ্যের যে ক্রাইসিস সেটা যেমন দূর হবে, অন্যদিকে এই মেশিনারি রক্ষা পাবে। 

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্রে জানা গেছে, খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের মধ্যে খালিশপুরে চারটি ও ভৈরব নদের ওপর পাড়ে দিঘলিয়ায় একটি পাটকল ছিল। এছাড়া ফুলতলার আটরা শিল্প এলাকায় দুটি ও যশোরে দুটি পাটকল রয়েছে। 

গত বছরের জুলাই মাসের শুরুতে শ্রমিকদের ‘গোল্ডেন হ্যান্ডসেক’ দিয়ে মিলগুলো বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর কয়েকদিন অপেক্ষার পর পরিবার নিয়ে এলাকা ছাড়তে শুরু করেন শ্রমিকরা। সর্বশেষ যেসকল শ্রমিকরা কলোনিতে থাকতেন তাদের ঘর-বাড়ি মিল কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া সাপেক্ষে হ্যান্ডসেকের টাকা পেয়েছেন।  

মোহাম্মদ মিলন/এসপি