যমুনা চরের কৃষকরা ভুট্টায় স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন

সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী বিধৌত কাজিপুর উপজেলার যমুনা চরের কৃষকরা ভুট্টায় স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। অধিক লাভ ও ভালো ফলনে ভুট্টা চাষে আগ্রহ বেড়েছে বেশির ভাগ কৃষকের। গত বছরের মতো এখন ভুট্টা চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

গত বছর ভুট্টা চাষে ভালো লাভ হওয়ায় এবার তার প্রসার বেড়েছে অনেক গুণ। ভাঙনকবলিত এব জনপদে প্রতিবছর হাজার হাজার আবাদি জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। কৃষক হয়ে পড়েন দিশেহারা। সর্বস্ব খুইয়ে একসময়ের ধনী মানুষটিও হয়ে পড়েন দিনমজুর। মহাজনের পাওনা পরিশোধে বিক্রি করতে হয় হালের বলদ।

এ অবস্থার উত্তরণে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে পাল্টে যাচ্ছে কৃষকের জীবন-জীবিকা ও চাষাবাদের ধরন।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কৃষক ও কন্ট্রাক্টর কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ৪৫টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়। ওই অর্থবছরের রবি মৌসুমে ৫ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমি চাষের আওতায় আসে এবং গড় ফলন হয় ৮.৮৫ টন/হেক্টর। ভুট্টার মোট ফলন হয় ৪৮ হাজার ৪৮৭ মে. টন। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ কর হয়। বর্তমানে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ মৌসুমে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৮৬০০ হেক্টর জমিতে।

এবার নদীকে শাসন করে তার উর্বর পলিমাটিতে চলছে সনাতনপদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ। উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশাল চরাঞ্চলসহ বিড়া অঞ্চলে ভুট্টা ফসলকে লক্ষ্য করে চাষাবাদে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে কাজিপুর উপজেলার কৃষি অফিস।

কৃষকদের ভুট্টা চাষে আগ্রহ সৃষ্টি করতে দুই বছর আগে কৃষি অফিস একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ফলে দুই বছর হলো আগের চেয়ে প্রায় ১ হাজার ১০০ হেক্টর জমি বেড়ে ৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪০০ থেকে ৪৫০ মণ। 

এবার চাষ বেড়েছে অনেক গুণ

এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে ইতিমধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় বিভিন্ন প্রকল্প, পুষ্টি প্রকল্প, বীজ ও বালাইনাশক সরবরাহকারী বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিস। বিড়া ও দুর্গম চরাঞ্চলে ভুট্টাচাষি কৃষক দল গঠন ও উৎপাদিত ভুট্টা সঠিক মূল্যে বিক্রির জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কৃষক কন্ট্রাক্টর তৈরি, নতুন জাতের ভুট্টার প্রদর্শনী প্লট স্থাপন, দলভুক্ত কৃষক ও কন্ট্রাক্টরদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও সুষম সারের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি বালাই দমনে গুণগতমান সমৃদ্ধ বালাইনাশক এবং হাইব্রিড জাতের বীজের সরবরাহ নিশ্চিতকরণের মতো কাজ করে যাচ্ছেন তারা। ফলে কৃষকদের মধ্যে ভুট্টা চাষের আগ্রহে সৃষ্টি হয়েছে।

সর্বশেষ এ বছরে ৮ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষকরা কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন ফিড উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে শুকনা ভুট্টা গড়ে ৬৫০ থেকে ৭৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছেন। আর ভুট্টার চাহিদাও রয়েছে বেশ। ফলে অন্যান্য ফসলের চেয়ে এ ফসলে লাভের পরিমাণ বেশি।

উপজেলার নতুন মাইজবাড়ী চরের ভুট্টাচাষি জহুরুল ইসলাম বলেন, গতবার কৃষি স্যারদের পরামর্শে ভুট্টার চাষ করে অন্য সব ফসলের চেয়ে বেশি টাকা পাইছি। এবারও ভুট্টার চাষ করছি।                 

মনসুরনগরের চাষি মানিক মিয়া বলেন, ফলন ভালো পাই। পাশাপাশি ভুট্টার কোনো কিছুই ফেলে দিই না। এর পাতা গরুকে খাওয়াই, ডাটা/কাণ্ড ও মোচা লাকড়ি হিসেবে বাজারে বিক্রি করি। নাটুয়াপাড়া ভুট্টাচাষি রুবেল বাবু বলেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে ভুট্টায় লাভ বেশি হয়। তাই ধীরে ধীরে ভুট্টা চাষে জমির পরিমাণটা বাড়ছে।

কাজিপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে জানান, এ বছর রাজস্ব খাতের মাধ্যমে ৪৫০টি এবং আরও কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন ও হাইব্রিড জাতের ভুট্টার মাঠ প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন এবং কৃষকের সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করছেন।

মানসম্মত বীজ সরবরাহ করতে বিভিন্ন হাইব্রিড বীজ আমদানিকারক কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কৃষকদের মাঝে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আইসিএম/আইপিএম/আইএফএমএসএসের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণ চলছে। কৃষি অফিসের পরামর্শে কৃষকেরা এবার কনক-৫১ এবং সিনজেনটার ৭৭২০ জাতের ভুট্টার বীজ রোপণ করেছেন বলে জানান তিনি।

রেজাউল করিম বলেন, কাজিপুরের যমুনাবিধৌত মাটি ভুট্টা চাষের জন্য উপযোগী। ফলনও ভালো। নিবিড় প্রশিক্ষণে কৃষকরা ভুট্টা চাষে লাভবানও হচ্ছেন। তিনি জানান, ভুট্টায় ইদানীং ফল আর্মি ওয়ার্ম (fall army warm) নামে একধরনের পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তবে আমরা সেটা দমনে কাজ করছি ও কৃষকদের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তা ছাড়া গত বছর ৩ হাজার ৮০০ জন এবং এ বছর ২ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।


শুভ কুমার ঘোষ/এনএ