অনেক আশা নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের বিশাল একটি সংখ্যা গত এক বছরে যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে গেছেন; যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা হ্রাসের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন একটি গবেষণায় ব্রিটেনে জনসংখ্যা হ্রাসের এই শঙ্কার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক স্ট্যাটিসটিকস সেন্টার অব এক্সসেলেন্স (ইএসসিওই) বলছে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন বিদেশে জন্ম নেয়া ১৩ লাখ মানুষ; যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করতেন। করোনাভাইরাস মহামারিতে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে অভিবাসীদের যুক্তরাজ্য ত্যাগের এই ঘটনাকে ‌‘নজিরবিহীন প্রস্থান’ বলছে ইএসসিওই।

অভিবাসীদের মধ্যে যারা যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন; তাদের বেশিরভাগই লন্ডনে বসবাস করতেন। ইএসসিওই বলছে, ওই একই সময়ে রাজধানী শহর লন্ডন ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় ৭ লাখ মানুষ। আর এই সংখ্যা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে মাত্র ১৪ মাসের অল্প কিছু বেশি সময়ে এই শহরের জনসংখ্যা কমে গেছে প্রায় ৮ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের শ্রম পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্যের ভিত্তিতে এই বিশ্লেষণ তৈরি করেছে ইএসসিওই।

২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ছেড়েছেন বিদেশে জন্ম নেয়া ১৩ লাখ মানুষ; যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করতেন।

ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক স্ট্যাটিসটিকস সেন্টার অব এক্সসেলেন্স (ইএসসিওই)

গবেষকরা বলছেন, বিদেশি কর্মীদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল কিছু খাত যেমন- আতিথেয়তা শিল্পের অনেক কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এটা মনে হচ্ছে, করোনাভাইরাস মহামারির সময় চাকরি হারানোর ক্ষতির বোঝা অভিবাসী কর্মীদেরই বেশি বহন করতে হয়েছে। বেকারত্বের ফলে অভিবাসীদের ব্রিটেন ছাড়ার সংখ্যা বেড়ে গেছে।

প্রস্থানে জ্বালানি ব্রেক্সিট-মহামারি

করোনাভাইরাস মহামারিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে যুক্তরাজ্য। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৮৬ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে করোনা। লাখ লাখ মানুষের জীবন কঠিন হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। 

শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত ৩০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মন্দায় পড়েছে যুক্তরাজ্য।

ব্রিটেন ছেড়ে আসা বেশ কয়েকজন অভিবাসী কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেছেন, নিজ দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তে করোনাভাইরাস মহামারি বড় সমস্যা ছিল না। বরং তারা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ব্রিটেনের অত্যন্ত জটিল প্রস্থানই অভিবাসীদের দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তে বেশি প্রভাব ফেলেছে।

ফ্রিজা গ্রাফ-ক্যারুথারস (৫০) গত ৩০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করে আসছিলেন। জার্মান এই নাগরিক বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির হুমকিই তাকে ২০২০ সালের জুনে নিজ দেশ জার্মানিতে ফিরতে বাধ্য করেছে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ২০১৬ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে অভিবাসনবিরোধী বাক-বিতণ্ডা বেড়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক গ্রাফ বলেন, ব্রেক্সিট ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আমি যুক্তরাজ্য ছাড়ার পরিকল্পনা করি। যুক্তরাজ্য ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আমাকে বেশ কষ্ট দিয়েছিল। কারণ ৩০ বছর ধরে সেখানে আমার ক্যারিয়ার গড়েছি। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি তৈরি হয়েছিল।

৩২ বছর বয়সী প্রকল্প ব্যবস্থাপক ফাবিয়ান ভেলা লন্ডন থেকে গত বছর নিজ দেশ ফ্রান্সে ফেরার পেছনে ব্রেক্সিটই প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে, ইউরোপ একটি ভালো কাজই করছে। আমার মনে হয়নি যে, এমন একটি দেশে বসবাস করি; যে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে আর থাকতে চায় না। করোনাভাইরাস মহামারি আমার সেই ইচ্ছাটাকে ফ্রান্সে ফিরতে বাধ্য করছে।  

ফেরার কোনও পরিকল্পনা নেই

ইএসসিওইর গবেষণা বলছে, অভিবাসীদের এই প্রস্থান হতে পারে সাময়িক। করোনা মহামারির প্রকোপ কমে গেলে কেউ কেউ ফিরতেও পারেন। তবে তারা নাও ফিরতে পারেন বলে সতর্ক করে দিয়ে গবেষকরা বলেছেন, এর ফলে যুক্তরাজ্য বিশেষ করে লন্ডনে গভীর প্রভাব পড়তে পারে।

তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে অভিবাসীদের লন্ডন ত্যাগের ঘটনা আগেও দেখা গেছে। এর আগে ১৯৭০ এর দশকে লন্ডনের জনসংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ কমে যায় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে টোড ফোরম্যানের। গত বছর লন্ডন ছেড়েছেন তিনিও। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের ঘটনায় গত অক্টোবরে প্যারিসে পাড়ি জমান টোড। লন্ডনে ফেরার তার কোনও পরিকল্পনা নেই বলে জানান। টোড বলেন, ইংল্যান্ডে ফিরে বসবাসের জন্য আমার কোনও পরিকল্পনা বা ইচ্ছা নেই।

এসএস