কে এই মিন অং হ্লেইং?
অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লেইং।
পাঁচ দশকের স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ মিয়ানমারে গণতন্ত্রের শৈশবকাল কাটতে না কাটতেই তা আবারও হোঁচট খেল। কোন প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সোমবার দেশটির সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। এরপর দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের কাছে মিয়ানমারের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেন তিনি। সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে এক বছরের জরুরি অবস্থা শেষে নির্বাচনের আয়োজন করে বিজয়ী বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা অবশ্য দেওয়া হয়েছে।
গণতান্ত্রিক যাত্রার দশক না পেরোতেই মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের পর আবারও আলোচনায় এসেছেন দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং। তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে আলোচনা। এর আগে ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রক্তাক্ত অভিযানের পর বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়েছিলেন তিনি। রাখাইনে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও হয়েছে তার নেপথ্যে ছিলেন এই জেনারেল। বয়স ৬৫ হয়ে যাওয়ায় আগামী জুলাইয়ে তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মিয়ানমারকে আবারও ফেরালেন সামরিক সরকারের অন্ধকার গলিতে।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের প্রতিরক্ষা বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছে, গত বছরের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকার এবং জাতীয় নির্বাচন কমিশন নিতে মিয়ানমারের ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষমতাগ্রহণ ছাড়া সেনাবাহিনীর সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি ৮৩ শতাংশ ভোট নিয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়েছিল।
মিন অং হ্লেইং এক বছরের জরুরি অবস্থা শেষে নির্বাচনের আয়োজন করবেন কিনা সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। কেননা আগামী জুলাইয়ে নিয়ম অনুযায়ী তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তিনি উত্তরসূরি বিষয়ক প্রস্তুতির বদলে অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা নিজের দখলে নিলেন। আর মিয়ানমারের স্বৈরশাসনের ইতিহাসও বলছে ভিন্নকথা।
বিজ্ঞাপন
মিন অং হ্লেইংয়ের উত্থান
ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত আইনে পড়াশোনা করেছেন জেনারেল মিন অং হ্লেইং। সে সময় থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় মিন। ২০১৬ সালে রয়টার্স মিনের এক সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলে। ওই সহপাঠী জানিয়েছিলেন, মিন স্বল্পভাষী ছিলেন। তিনি একটু আড়ালেই থাকতেন।
মিন অং হ্লেইং মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ত্যাভয়ে ১৯৫৬ সালের ৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন, যে শহর এখন দাওয়েই নামে পরিচিত। আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষে মিন সেনাবাহিনীর বিশ্ববিদ্যালয় ডিফেন্স সার্ভিসেস একাডেমিতে (ডিএসএ) যোগ দিতে আবেদন করেন। তৃতীয়বারের চেষ্টায় ১৯৭৪ সালে তিনি সফল হন।
ছোটবেলার বন্ধুরা তাকে ‘স্বল্পভাষী’ হিসেবে অভিহিত করেন। অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসিত মিয়ানমারের লেখক হ্লা ও তাকে ছোটবেলা থেকে চিনতেন। তিনি মিন অং হ্লেইংকে ‘কঠোর পরিশ্রমী’ বলছেন। ডিএসএ ক্লাসে মিনের এক সহপাঠী ২০১৬ সালে রয়টার্সকে বলেন, মিন গড়পড়তা শিক্ষার্থী ছিলেন। মিনকে মাঝারি র্যাঙ্ক থেকে এত ওপরে উঠতে দেখে বিস্মিত হয়েছেন তিনি। তবে মিন হঠাৎ করেই কমান্ডার ইন চিফ হয়ে ওঠেননি।
সেনাবাহিনীর বিভিন্ন র্যাংক পার করার পর তিনি কমান্ডার ইন চিফ হয়েছেন। ২০১১ সালে থান শাওয়ে মিন অং হ্লেইংকে অং সান সু চির শাসনামলে সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে উন্নীত করেন। থান শাওয়ে মনে করেছিলেন মিন অং হ্লেইং তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কিন্তু পূর্বসূরীদের মতোই তিনিও ক্ষমতা দখলে নিলেন।
মিয়ানমারে নির্বাচনী গণতন্ত্র শুরুর সময় থেকে মিন সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে। ইয়াঙ্গুনের কূটনীতিকরা বলছেন, ২০১৬ সালে সু চি প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার সময় থেকে মিন পেছনের সারিতে থাকা সেনাসদস্য থেকে রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠেন। মিয়ানমারের রাজনীতির ওপর সামরিক বাহিনীর শক্ত নিয়ন্ত্রণ খুব শিগগির কমানোর কোনও ইচ্ছে যে তার নেই— তা তিনি আগে নানাভাবে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
ক্ষমতালিপ্সু এক জেনারেল
২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের রাজনীতিতে মিন অং হ্লেইংয়ের প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন দীর্ঘদিনের। সু চির একজন উপদেষ্টা ইউ উইন টিন বলছেন, ২০২০ সালের মধ্যে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনা আগেই করে রেখেছিলেন তিনি।
কিন্ত গত নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এনএলডির এই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিন অং হ্লেইং কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। যে কারণে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে মিয়ানমারের রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। তৈরি হয় সামরিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা। যা সত্য প্রমাণিত হয় সোমবার।
ক্ষমতা দখলের পথ পরিক্রমা
সেনাপ্রধান হয়েই মিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের কর্মকাণ্ড প্রচার শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে সফর করেন। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন। তার প্রোফাইলে অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মিন।
দায়িত্ব পেয়ে মিন অং হ্লেইং সামরিক বাহিনীতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করেন এবং তিনি সু চির সঙ্গে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মধ্যস্থতা করেন। তবে সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি উভয়দিকেই খেলেছেন। সরকারের সঙ্গে নিজের আচরণ সংযত রেখেছেন ও সরকারকে মোকাবিলা করা থেকে বিরত থেকেছেন।
কিন্তু সেনাবাহিনীকে দেখানোর জন্য যতটুকু সম্ভব তিনি রাজনৈতিক খেলা খেলেছেন। ২০১৭ সালে এক রাষ্ট্রীয় সফরে তিনি চীন ও জাপানে যান এবং সেখান থেকে বৈদেশিক সমর্থন নিয়ে আসেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সফরে যতগুলো বৈঠক হয়েছিল তার প্রায় সবগুলোই সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছিল তখন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকেরা রয়টার্সকে বলেছেন, লিবিয়া ও মধ্যপূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোয় ২০১১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর নৈরাজ্য পরিস্থিতি এড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মিন।
মিয়ানমারের কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লেইং সব সময়ই পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ ২৫ শতাংশ আসন ধরে রাখতে চেয়েছেন। সু চিকে প্রেসিডেন্ট হতে বাধা দেয়—সংবিধানের এমন ধারার বদলও চাননি তিনি।
গত ৮ নভেম্বরে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনী সু চির জয় নিয়ে সমালোচনা হয়েছে সেসব সমালোচনা ও অভিযোগ মিন অং হ্লেইংও তুলেছেন।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিজের পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়িয়েছিলেন তিনি। অথচ সেনাবাহিনীর নিয়মিত রদবদলের অংশ হিসেবে সে সময় তার পদত্যাগ করার কথা। তখন থেকেই সন্দেহ বাড়তে শুরু করে।
ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সেন্টার ফর সাউথইস্ট এশিয়ান স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক নেহগিনপাও কিপগেন বলছেন, প্রথমে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে সেনা নজরদারিতে পুনরায় নির্বাচনের কথা বলেও কাজ না হওয়ায় ক্ষমতা দখল করা ছাড়া তার কাছে আর কোনও উপায় ছিল না।
তিনি বলেন, আসলে গেল নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে সামরিক বাহিনী। মিনের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে এই অভিযোগ। তাই রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিন অং হ্লেইংকে লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রুপ দিতে কোনো বেগ পেতে হয়নি।
এএস