ছবি : সংগৃহীত

পৃথিবী থেকে আনিসুল হকের প্রস্থান কেবল যে আকস্মিক এবং অসময়ের তা নয়, তার চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই ক্ষতি কেবল তার পরিবারের নয় বরং যেসব ক্ষেত্রে তার পদচারণা ছিল সব ক্ষেত্রেই।

টেলিভিশন, শিল্প সংস্কৃতি, রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পসহ ঢাকা মহানগরীর সব অধিবাসী তার মৃত্যুতে একই রকম শোকবিহ্বল হয়েছেন। এর অন্যতম কারণ তার নেতৃত্ব ও প্রজ্ঞা যা সকলকে স্পর্শ করেছে।

টেলিভিশনে অন্যতম জনপ্রিয় উপস্থাপক ছিলেন তিনি। তার উপস্থাপনায় ছিল প্রস্তুতির ছাপ, আত্মবিশ্বাস এবং প্রত্যয়। দর্শকদের তিনি ধরে রাখতে জানতেন। তার সরস ও বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা বিষয়গুলো দর্শকদের কাছে প্রাসঙ্গিক করে তুলতেন।

আরও পড়ুন : হেলাল হাফিজের রাজনৈতিক পাঠ 

তিনি দর্শকদের ভাবতে ও চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তাই সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ে তার বক্তব্য শুনতে দর্শকরা অপেক্ষা করতেন।

জনপ্রিয় এই উপস্থাপক তার সব কাজেই জনসম্পৃক্ততার ওপর জোর দিতেন। ব্যস্ত ব্যবসায়ী জীবনেও শিল্প সংস্কৃতিকে তিনি বিসর্জন দেননি। তার সংগ্রহে থাকা প্রচুর শিল্পকর্ম সাক্ষ্য দেয় যে ব্যবসায়ী সত্ত্বা ও শিল্প সত্ত্বাকে তিনি পরিপূরক করতে পেরেছেন।

প্রচলিত রাজনৈতিক ভাষায় নয়, আনিসুল হক চিত্র শিল্পের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সাথে এদেশের তরুণ প্রজন্মকে পরিচিত করিয়ে দিতে এক ব্যতিক্রমী প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। ভিন্নতার জন্য তার সেই আয়োজন বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল।

কেবল শিল্প নয়, শিল্পীর প্রতিও দায়বদ্ধতা ছিল তার। সংস্কৃতি অঙ্গনে বিপদগ্রস্ত কোনো শিল্পী তার সহযোগিতা চেয়ে বিমুখ হননি। এসব তিনি প্রচার করেননি, কিন্তু তার প্রস্থানের পর আমরা জানতে পেরেছি যে দুর্দশাগ্রস্ত শিল্পীদের সহায়তায় তিনি কয়েকজন সাথে নিয়ে একটি বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়ে এগোচ্ছিলেন। 

আরও পড়ুন : রূপসী বাংলার ক্ষত ও জীবনানন্দ দাশ 

শৈল্পিক মানসিকতার অধিকারী আনিসুল হক হয়ে উঠেছিলেন ঢাকার মেয়র প্রিয় আনিস ভাই। অল্প সময়ে নগর পিতার দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন এতটাই একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সাথে যে জীবনাবসানেও তাকে অনেকেই এখনো ‘মেয়র আনিস’ বলে স্মরণ করেন।

কেবল সৌন্দর্য বর্ধনকারী ফুটপাত বা আলোক সজ্জিত হাতিরঝিল নয়, বিবর্ণ ঢাকায় ছাদ বাগানের প্রসারে কিংবা ব্যক্তিগত ঝুঁকি উপেক্ষা করে তেজগাঁও থেকে বাস স্ট্যান্ড সরিয়ে যানজট কমাতে আনিস ভাইয়ের অবদান নগরবাসী সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

আনিস ভাই উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। ঢাকাবাসীকে একটি আধুনিক নগর পরিবহন ব্যবস্থা উপহার দিতে চেয়েছিলেন। বিশৃঙ্খল বাস ও গণপরিবহন সরিয়ে জনবান্ধব গণপরিবহনের একটি রূপরেখাও তিনি বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রস্তুত করেছিলেন। প্রথমবারের মতো নগরবাসী যখন উপলব্ধি করা শুরু করল যে একজন উদ্যোমী নগর পিতা চাইলেই বাধা পেরোনোর কাজ করতে পারেন ঠিক তখনই স্রষ্টার ডাকে চলে যেতে হলো তাকে।

তার প্রস্থানের পর ঢাকার শৈল্পিক বিবর্তনের স্বপ্ন আবার বড় রকমের হোঁচট খেল। আনিস ভাই বেঁচে থাকলে কি এতদিনে ঢাকা শহরের সব ছাদ সবুজ হয়ে যেত? সম্ভব হতো কি আবারও রাস্তা দখল করে তেজগাঁওয়ে বাস স্ট্যান্ড বসানো? দুই বাসের সংঘর্ষে কাটা পড়তো কি কোনো নগরবাসীর হাত? এসবের উত্তর খুঁজতে গেলে বিমর্ষ হয়ে পড়ি।

আরও পড়ুন : রবীন্দ্র ভাবনায় তারুণ্য

এবার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে পেশাগত কাজের কারণে ব্যক্তিজীবনে চরম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। দুই দিন পর স্বস্তি ফিরলে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়েছিল।

দুঃস্বপ্নের দুটি রাত কাটিয়ে ১৬ এপ্রিল সকালে দরজা খুলে দেখি আনিস ভাই সামনে দাঁড়িয়ে। দেখে বুঝেছিলাম আমার দুশ্চিন্তা ও প্রবল অনিশ্চয়তা তাকেও স্পর্শ করেছিল। শুক্রবার সকালে তাই নারায়ণগঞ্জ কোর্টে যাওয়ার সময় আনিস ভাই আমার ও আমার স্বামীর সঙ্গী হয়েছিলেন।

আনিস ভাই, আপনার জন্য প্রার্থনা। আমি নিশ্চিত এই মহানগরীর কোটি মানুষের সুন্দর বাসযোগ্য ঢাকার স্বপ্নের মাঝে আপনি বেঁচে থাকবেন।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ।। প্রধান নির্বাহী, বেলা