ছবি : সংগৃহীত

সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চলচ্চিত্রটি ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কার লাভ করে। এই চলচ্চিত্র তখনকার ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাঁকবদল বলে অনেকেই মনে করেন।

প্রথম চলচ্চিত্রে দারিদ্র্যের চিত্র দৃশ্যায়িত হলেও কোনো রাজনৈতিক বার্তা ছিল না। কিন্তু তারপরের কয়েকটি চলচ্চিত্র? নাহ, সামাজিক সমস্যা তার চলচ্চিত্রে উঠে এলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিত্রায়িত হয়নি। সেজন্যেই ষাটের দশকের শেষে আর সত্তরের দশকে যখন পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যসংকট, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশি শরণার্থীর সমস্যায় উত্তাল, তখন সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে এক শ্রেণির সমালোচকেরা বলতেন, তার চলচ্চিত্র যথেষ্ট র‌্যাডিক্যাল নয়।

অনেকেই মনে করতেন যে, সত্যজিৎ তার সেরা কাজগুলো করেছেন উনিশ শতকে, এই চলচ্চিত্রগুলো—সেই সময়কার মধ্যবিত্ত বাঙালির ভুবন নিয়ে নির্মিত।

মৃণাল সেন একসময় তার চলচ্চিত্রকে বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের কথা প্রচার করেছিলেন, সত্যজিৎ কখনোই তেমন করেননি। তিনি রাজনীতির চেয়ে শিল্পের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ ছিলেন। না, সেজন্য তাকে কখনোই অরাজনৈতিক মনোভাবের শিল্পী বা মানুষ বলা যাবে না। 

কিন্তু ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫, এই ছয় বছরে যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করলেন সত্যজিৎ, তাতে এইসব ধারণা ভেঙে খানখান হলো। এই ক’বছরে সত্যজিৎ যে চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করলেন, সেগুলো ভারতীয় পর্দায় দেখা সবচেয়ে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে—‘অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮)’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০)’, ‘সীমাবদ্ধ (১৯৭১)’ এবং ‘জন অরণ্য (১৯৭৬)’। এই সময়পর্বেই নির্মিত হলো ‘অশনি সংকেত (১৯৭৩)’, ‘সোনার কেল্লা (১৯৭৪)’ এবং দু’টি তথ্যচিত্র—‘দি ইনার আই (১৮৭২)’ ও ‘সিকিম (১৯৭১)’।

এইসব চলচ্চিত্রে সত্যজিতের রাজনৈতিক চেতনাকে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের অন্যান্য অংশের বামঘেঁষা প্রগতিশীলতার চেনা ছকে ধরা যাবে না। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। তার চলচ্চিত্রায়ণ করেন সত্যজিৎ রায়।

রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, নিষ্ফলা রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সমাজের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে সত্যজিৎ রায় যে কিছুটা ক্ষুণ্ণ ছিলেন, তা নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ‘গণশত্রু (১৯৯০)’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

সব বাঙালির কাছে জনপ্রিয় এই চলচ্চিত্রটির অন্দরে নিহিত যুদ্ধবিরোধী স্বরকে হয়তো হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন অনেকেই। আপাতদৃষ্টিতে ছোটদের জন্য তৈরি এই রূপকথার চলচ্চিত্রে স্পষ্টতই সত্যজিতের চিন্তাজগত জুড়ে ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০)’ চলচ্চিত্রেও তাই। বিশ শতকের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা চন্দ্রাভিযান নয়, ভিয়েতনামের কৃষকদের প্রতিরোধ—সিদ্ধার্থের জবানিতে প্রকৃত সত্য জানিয়েছেন সত্যজিৎ নিজেই।  

‘জন অরণ্য (১৯৭৬)’ চলচ্চিত্রের নায়ক সোমনাথ ইতিহাসেরই ছাত্র ছিল। সত্তর দশকের কিংবদন্তিতুল্য লোডশেডিং তার ডিগ্রিটি যে অবান্তর করে দেয় তা, সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক বক্তব্য।

যে অপু পঞ্চাশ দশকের শেষে অধ্যক্ষের ঘরের বাইরে ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান শুনেছিল সে আজ দেখতে পায়, দেয়াল লেখায় চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর স্টেনসিল কীভাবে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ ইন্দিরা গান্ধীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০)’ চলচ্চিত্রে সিদ্ধার্থ, ফিল্ম ডিভিশনের তথ্যচিত্রে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গল্প শুনতে শুনতে হলের সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে।

শহরের নবনির্মাণ, জ্ঞানের বিস্তার ও কারিগরি উৎকর্ষ—এই পথেই আমাদের চেতনার ক্রমমুক্তি তা ডাক্তারির অসফল ছাত্র সিদ্ধার্থ চৌধুরীর মধ্যে অনেকটাই সন্দিগ্ধ রূপ নিয়েছে। সে নারীর স্তন থেকে সামাজিক প্রাণ পর্যন্ত সবকিছুতেই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে আনে। সিদ্ধার্থ অসহায়। সিদ্ধার্থ অনিশ্চিত। সিদ্ধার্থ দ্বিধাগ্রস্ত। একই রকম দোলাচলে দীর্ণ শ্যামলেন্দুকে আমরা আবিষ্কার করেছি ‘সীমাবদ্ধ (১৯৭১)’ চলচ্চিত্রে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে সকালবেলায়।

তার সার্থকতার সিঁড়ি অব্যক্ত ও নিষ্ঠুর। উন্নতির পথে ছলনার আশ্রয় নিতে তার মনুষ্যত্ব থমকে দাঁড়ায় না। আর ‘জন অরণ্য (১৯৭৬)’-তে সোমনাথ মেয়েমানুষের খোঁজে নৈশ অ্যাডভেঞ্চার শুরু করলে সত্যজিৎ রায়ের আত্মগ্লানি তিক্ততার শিখরে পৌঁছে যায়।

আবার ‘পিকু (১৯৮০)’ যেমন নির্জ্ঞান থেকে যৌনতার সংকট দেখতে পায়, তেমনই ‘গণশত্রু (১৯৯০)’ চলচ্চিত্রে ‘দিস চরণামৃত অ্যান্ড অল আদার চরণামৃত আর ফ্রি ফ্রম জার্ম...’ সংলাপ তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বর্ণনা করে।

সাহিত্যিক হেনরিক ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল' নাটক অবলম্বনে তৈরি ১৯৮৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশত্রু (১৯৯০)’ চলচ্চিত্রে ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক আদর্শ চিত্র ফুটে উঠেছে তীব্রভাবে। সেই চলচ্চিত্র আজও প্রতিটা মুহূর্তে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে রাজনীতির প্রকৃত রূপকে।

সত্যজিৎ রায়ের যে চলচ্চিত্রটি রাজনীতির দৃষ্টিতে কালজয়ী তা হলো ‘হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)’। তিনিই প্রমাণ করে গেছেন শিল্পসৃজন ও রাজনৈতিক ভাবধারা, সমাজ সচেতনতা হাত ধরাধরি করে চলতেই পারে।

রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতা, নিষ্ফলা রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও সমাজের নৈতিক অবক্ষয় নিয়ে সত্যজিৎ রায় যে কিছুটা ক্ষুণ্ণ ছিলেন, তা নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ‘গণশত্রু (১৯৯০)’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।

তবে সত্যজিৎ রায়ের যে চলচ্চিত্রটি রাজনীতির দৃষ্টিতে কালজয়ী তা হলো ‘হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)’। তিনিই প্রমাণ করে গেছেন শিল্পসৃজন ও রাজনৈতিক ভাবধারা, সমাজ সচেতনতা হাত ধরাধরি করে চলতেই পারে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সত্যজিৎ রায়ের বহু চলচ্চিত্রে এই কথাই বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। এসেছে রূপকের আড়ালে।

চলচ্চিত্রর প্রথমভাগে রাজ অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করছে—‘অনাচার কর যদি রাজা তবে ছাড়ো গদি। যারা তার ধামাধারী, তাদেরও বিপদ ভারী।’ যাকে চলচ্চিত্রর শেষের দিকে দেখা যায় হীরক রাজাসহ পরিষদদের যন্তরমন্তর মগজধোলাই ঘরে ঢুকিয়ে মগজধোলাইয়ের মন্ত্র দিতে।

প্রসঙ্গত এই চলচ্চিত্র যখন তৈরি হয় তখন দেশে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। দেশে চলছে ইমার্জেন্সি পরবর্তী থমথমে পরিস্থিতি। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই চলচ্চিত্র কি প্রতিবাদের স্বরূপ হয়ে ওঠেনি? শুধু এটুকুই না, ‘হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)’-এর প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে সমকালীন সমাজে কৃষক শ্রমিক মানুষের যন্ত্রণার কথা।

যেমন যন্তরমন্তর মগজধোলাই ঘরে কৃষকের জন্য মন্ত্র হলো—‘বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না’, ‘ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই’, ‘যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান’। বর্তমান প্রেক্ষিতে প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক মৃত্যুর সাথে কি মিল তাই না?

জীবনের শেষ চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক (১৯৯১)’-এ বললেন ‘অসভ্য’ থেকে আমরা ক্রমে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির গুণে ‘সভ্য’ হচ্ছি, এই বিশ্বাস তার নেই। ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভি-স্ত্রস (Claude Levi Strauss)-এর রচনা মন দিয়েই পড়েছিলেন সত্যজিৎ।

সত্যজিতের ‘আগন্তুক (১৯৯১)’ চলচ্চিত্রেও উঁকি দিয়ে যায় ব্যক্তিগত ঈশ্বরের অনুভব। বিদেশি পুঁজিতে কৃষ্ণের নামে ধর্মীয় সমারোহের যে হুজুগেপনা, তারই উল্টো দিকে উৎপল দত্তের কণ্ঠে পরিচালক সত্যজিৎ স্বয়ং গেয়ে ওঠেন ‘হরি হরায়ে নমঃ’। না, মাথা নত করে অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেননি সত্যজিৎ, শুধু খেয়াল করিয়েছিলেন ধর্ম যদি রাখতেই হয়, তবে তা থাকবে মানুষের একান্ত অনুভবের বিস্ময়ে।

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে মূলত রাজনীতি এসেছে তার আপাত নিরপেক্ষ, কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে। সত্যজিতের রাজনীতি-চিন্তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা কম হওয়ার কারণই হলো, তাকে চট করে কোনো খোপে ফেলা মুশকিল। একে তো স্লোগানের চেয়ে মূল্যবোধে আস্থা তার বেশি, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে তার বিচিত্রগামিতা।

‘পথের পাঁচালী (১৯৫৫)’ বা ‘সদগতি (১৯৮১)’-তে সত্যজিতের ‘শ্রেণিচেতনা’ বামপন্থীদের পছন্দ হয়, ‘জলসাঘর (১৯৫৮)’-এ ‘সামন্ততন্ত্রের প্রতি দরদ’ তাদের হতাশ করে। বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীরা ‘দেবী (১৯৬০)’ আর ‘মহাপুরুষ (১৯৬৫)’ নিয়ে উৎফুল্ল হন, ‘সোনার কেল্লা (১৯৭৪)’ তাদের উদ্বিগ্ন করে। নারীবাদীরা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২)’, ‘মহানগর (১৯৬৩)’, ‘চারুলতা (১৯৬৪)’-তে মুগ্ধ, কিন্তু গল্পে নারী চরিত্রের অল্প উপস্থিতি সবাইকে করেছে বিমর্ষ। 

সত্যজিৎ সবাইকে বড় ঝামেলায় ফেলে দেন। এমনকি সরকারকেও। রাজ্য সরকার ‘সোনার কেল্লা (১৯৭৪)’ প্রযোজনা করেছে বলে পরের চলচ্চিত্র ‘জন অরণ্য (১৯৭৬)’-তে সত্যজিৎ সরকারের সমালোচনা করবেন না, তা কিন্তু হয়নি। তিনি সমালোচনা করেছেন। তার রাজনীতি, তার চলচ্চিত্রের রাজনীতি নিয়ে বাজারে নানা রকম মতামত, সেই বিষয়ে তিনি কম ওয়াকিবহাল ছিলেন না। কিন্তু কোনো মহলকে কৈফিয়ত দেওয়া বা খুশি করার তাগিদ তিনি অনুভব করেননি।

বরং স্পষ্ট জানিয়েছেন—‘তথাকথিত প্রোগ্রেসিভ অ্যাটিচিউডের যে ফর্মুলাগুলো রয়েছে, এগুলো আমার কাছে খুব একটা ইন্টারেস্টিং, ভ্যালিড বা খুব একটা সঙ্গত বলে মনে হয়নি।’ সারা জীবন নিজের কাজের প্রতি সৎ এবং নিষ্ঠা থেকে যাওয়া এবং কাজের মধ্য দিয়ে নিজের বিশ্বাসকে প্রকাশ করাটাও আদতে একটা বৃহৎ রাজনীতি। এই কথাটুকু মনে রাখলে সত্যজিৎকে বুঝতে সুবিধা হতে পারে।

অমিত গোস্বামী ।। কবি ও কথাসাহিত্যিক