দেবী উপাসনা প্রাচীন বৈদিককাল থেকেই প্রচলিত। বেদের দেবীসূক্তসহ অসংখ্য সূক্তে, মন্ত্রে দেবীমাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। শ্রীসূক্ত, ভূসূক্ত, অরণ্য সূক্ত, রাত্রিসূক্ত, দেবীসূক্ত, দুর্গাসূক্ত এই সূক্তগুলো বৈদিক দেবীমাহাত্ম্যের জাজ্বল্যমান উদাহরণ।

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের দ্বিতীয় অনুবাকটি দুর্গাসূক্ত নামে খ্যাত। সূক্তটিতে এই জগৎ থেকে উদ্ধারের জন্য জীবের কর্মফলদাত্রী অগ্নিরূপা, অগ্নিবর্ণা দুর্গাদেবীর শরণ নিতে বলা হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে দুর্গাসূক্তের সাথে সাথে একটি দুর্গাগায়ত্রী মন্ত্রও আছে, মন্ত্রটি দুর্গাপূজায় আজও ব্যবহৃত হয়।

‘কাত্যায়নায় বিদ্মহে, কন্যাকুমারি ধীমহি।

তন্নো দুর্গিঃ প্রচোদয়াৎ।।’

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে দুর্গাস্তোত্র, দুর্গাগায়ত্রীর উল্লেখ থাকার পরেও কিছু মানুষ অজ্ঞানতা দ্বারা আছন্ন হয়ে বলে, বেদে কোনো প্রতিমা পূজার কথা নেই, দেবীদুর্গার কথা নেই; যা সত্যি হাস্যকর। অনেকেই, বিশেষ করে দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারী, আর্যসমাজের অনুসারীরা বিভিন্ন দেবদেবীর নাম, প্রসঙ্গ এবং মাহাত্ম্যকথা থাকায় বেদের ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদকে বেদ বলে মানেন না।

এমনকি তারা কৃষ্ণযজুর্বেদ সংহিতাতে বিভিন্ন দেবপ্রসঙ্গ থাকায়, কৃষ্ণযজুর্বেদ সংহিতাকেও বাদ দিয়েছেন। যা তাদের একান্তই কষ্টকল্পিত ব্যক্তিগত মত, যার সাথে বেদবেদান্তের বা আমাদের পূর্ববর্তী ঋষিমুনিদের পরম্পরাগত মতের সম্পর্ক নেই।

‘জাতবেদসে সুনবাম সোম-

মরাতীয়তো নিদহাতি বেদঃ।

স ন পর্ষদতি দুর্গাণি বিশ্বা

নাবেব সিন্ধুং দুরিতাত্যগ্নিঃ।।’

‘আমরা অগ্নির উদ্দেশে সোমলতার অভিষেক করি। সর্বজ্ঞ অগ্নি আমাদের শত্রুগণকে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করুন। অপিচ, সেই অগ্নি আমাদের সমস্ত বিপদাপদ বিনষ্ট করেছেন। যেমন নাবিক নৌকার দ্বারা সমুদ্র অতিক্রম করে, তেমনি অগ্নি আমার পাপসমূহ দূরীভূত করুন।’

কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকের দ্বিতীয় অনুবাকটি দুর্গাসূক্ত নামে খ্যাত। সূক্তটিতে এই জগৎ থেকে উদ্ধারের জন্য জীবের কর্মফলদাত্রী অগ্নিরূপা, অগ্নিবর্ণা দুর্গাদেবীর শরণ নিতে বলা হয়েছে।

‘তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং

বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।

দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে

সুতরসি তরসে নমঃ।।’

‘আমি সেই বৈরোচনী, জ্যোতির্ময়ী অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তাপে শত্রুদহনকারিণী, জীবের কর্মফলদাত্রী দুর্গাদেবীর শরণ নিলাম। হে সংসার-ত্রাণকারিণি দেবী তুমি আমার পরিত্রাণ করো, তোমায় প্রণাম।’

‘অগ্নে ত্বং পারয়া নব্যো অম্মান

স্বস্তিভিরতি দুর্গাণি বিশ্বা।

পূশ্চ পৃথ্বী বহুলা ন উর্বী ভবা

তোকায় তনয়ায় শংযোঃ।।’

‘হে অগ্নে, তুমি আমাদের স্তবযোগ্য হয়ে কল্যাণপ্রদ উপায়সমূহ দ্বারা সমস্ত বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে আমাদের সংসার-সমুদ্রের পরপারে নিয়ে যাও। তোমার অনুগ্রহে আমাদের বাসভূমি, পৃথিবী এবং শস্যনিস্পাদনযোগ্য ভূমিও বিস্তৃতিলাভ করুক। তুমি আমাদের পুত্ৰদানের জন্য সুখপ্রদ হও।’

‘বিশ্বানি নো দুর্গহা জাতবেদঃ

সিন্ধুং ন নাবা দুরিতাঽতিপর্ষি।

অগ্নে অত্রিবন্মনসা গৃণানো

অস্মাকং বোধ্যবিতা তনূনাম্।।’

‘হে জাতবেদ, তুমি আমাদের সমস্ত আপদের বিনাশক হয়ে নৌকা দ্বারা সমুদ্র অতিক্ৰমতুল্য আমাদের সব পাপ হতে উত্তরণ করো। হে অগ্নে, অত্রিঋষির ন্যায় তাপত্রয়মুক্ত হয়ে তুমি মন থেকে আমাদের কল্যাণ চিন্তা করো এবং আমাদের শরীরের রক্ষকরূপে সর্বদা অবস্থান করো।’

‘পৃতনাজিতং সহমানমুগ্ৰনাগ্নিং

হুবেম পরমাৎ সধস্থাৎ।

স নঃ পর্ষদতি দুর্গাণি বিশ্বা

ক্ষামদেবো অতিদুরিতাত্যগ্নিঃ।।’

‘আমরা পরসেনাজয়ী, শত্রুগণের অভিভবকারী, ভীতিহেতু সঅগ্নিকে উৎকৃষ্ট স্বীয় ভৃত্যগণসহ অবস্থানযোগ্য দেশ হতে আহ্বান করি। সেই অগ্নি আমাদের সমস্ত বিপদাপদ দূর করেছেন। অগ্নিদেব আমাদের মতো অপরাধীর সব দোষ সহ্য করে আমার যাবতীয় মহাপাপ বিনষ্ট করছেন।’

‘প্রত্নোষি কর্মীড্যো অধ্বরেষু

সনাচ্চ হোতা নব্যশ্চ সৎসি।

স্বাং চাগ্নে তনুবৎ পিপ্রয়-

স্বাস্মভ্যং চ সৌভগমায়জস্ব।।’

‘হে অগ্নে, তুমি কর্ণসমূহে স্তবযোগ্য হইয়া সুখ দান করে থাক। তুমি কর্মফলের দাতা, হোমনিষ্পাদক ও স্তবযোগ্য হয়ে কর্ণদেশে অবস্থান করো। তুমি হবি দ্বারা স্বকীয় শরীরের প্রীতি সম্পাদন করো। অনন্তর আমাদের সৌভাগ্য প্রদান করে থাকো।’

‘গোভির্জুষ্টমযুজো নিষিক্তং

তবেন্দ্র বিষ্ণোরনুসংচরেম।

নাকস্য পৃষ্ঠমভি সংবসানো

বৈষ্ণবীং লোক ইহ মাদয়ন্তাম্।।’

‘হে ইন্দ্র, ধেনুগণ-সেবিত এবং অমৃতধারা নিষিক্ত মহাভাগ্য লাভের নিমিত্ত নিষ্পাপ তোমার ও বিষ্ণুর সেবক হবো। স্বর্গের উপরিভাগে নিবাসশীল সমস্ত দেবতা অভীষ্ট ফল প্রদান দ্বারা বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ আমার ভক্তি বৃদ্ধি করুন।’

'জাতবেদ' শব্দের অর্থ প্রসঙ্গে বৈদিক নিরুক্তে বলা হয়েছে—

‘জাতবেদাঃ কস্মাৎ॥

জাতানি বেদ জাতানি বৈনং বিদুঃ,

জাতে জাতে বিদ্যত ইতি বা,

জাতবিত্তা বা জাতধনঃ,

জাতবিদ্যো বা জাতপ্ৰজ্ঞানঃ॥’

(নিরুক্ত : ৭.১৯.১-২)

‘জাতবেদস্ শব্দটি কী করে নিষ্পন্ন বা এর নির্বাচন বা বুৎপত্তি কী?

জাত বা উৎপন্ন সমস্তকেই ইনি জানেন; অথবা উৎপন্ন প্রাণিমাত্রই তাকে জানে; অথবা যা যা উৎপন্ন তৎসমস্তেই ইনি বিদ্যমান আছেন; অথবা ইনি জাতবিত্ত অর্থাৎ জাতধন—এ হতে ধন উৎপন্ন হয়; অথবা, ইনি জাতবিদ্য অর্থাৎ জাতপ্রজ্ঞান-ইনি নৈসর্গিক প্রজ্ঞানবিশিষ্ট।’

'জাতবেদস্' শব্দটির বৈদিক নিরুক্তে উক্ত ‘জাত বা উৎপন্ন সমস্তকেই ইনি জানেন অথবা উৎপন্ন প্রাণিমাত্রই তাকে জানে’ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অগ্নি অর্থে যেমন ব্যবহৃত হয়; তেমনি অগ্নিরূপা আদ্যাশক্তি দুর্গা অর্থেও ব্যবহৃত।

অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি দুর্গা জীবের সম্মুখে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্নিরূপা। তাই আদ্যাশক্তি দেবীর পূজায় প্রজ্বলিত অগ্নিতে হোম বাধ্যতামূলক। হোমে অগ্নিরূপা আদ্যাশক্তি মহামায়া কাছে বিবিধ দ্রব্যাদিতে হবি প্রদান করা হয়। সপ্তমন্ত্রের দুর্গাসূক্তটি সব বিপদাপদ এবং অনিষ্ট পরিহারের কামনায় জপ এবং যজ্ঞাহুতির বিধান দেওয়া হয়েছে।

অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি দুর্গা জীবের সম্মুখে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্নিরূপা। তাই আদ্যাশক্তি দেবীর পূজায় প্রজ্বলিত অগ্নিতে হোম বাধ্যতামূলক।

দুর্গাসূক্তের প্রথম মন্ত্রে জাতবেদ অগ্নির মাঝেই দুর্গাদেবীকে আহ্বান করে সব শত্রুকে বিনাশের প্রার্থনা করা হয়েছে। দেবীদুর্গা অগ্নিরূপা; অগ্নিরূপা দেবীর কাছে দক্ষ সমুদ্রের নাবিকের মতো সংসার সমুদ্র অতিক্রম এবং যুগপৎ সব পাপসমূহ থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানো হয়েছে।

দ্বিতীয় মন্ত্রে, ‘তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং’ বলে অগ্নিই যে দুর্গাদেবীর স্বরূপ তা প্রকাশিত করা হয়েছে। সেই মুক্তিপ্রদাত্রী বৈরোচনী জ্যোতির্ময়ী অগ্নিবর্ণা, শত্রুদহনকারিণী আদ্যাশক্তি দুর্গাদেবীই জীবের কর্মফলদাত্রী। তিনিই জীবকে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ করেন। বিপরীতে তিনিই আবার প্রসন্ন হয়ে জীবকে সংসারবন্ধন থেকে মুক্ত করেন, পরিত্রাণ করেন।

তৃতীয় মন্ত্রে, অগ্নিস্বরূপা দেবীর অনুগ্রহে বাসভূমি, পৃথিবী এবং শস্যনিস্পাদনযোগ্য ভূমির বিস্তৃতি লাভের সাথে সাথে কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়েছে। অগ্নিরূপা দেবীর কাছে পুত্ৰসন্তান দান করতে বলা হয়েছে। স্মর্তব্য সংস্কৃত পুত্র শব্দটি শুধুই পুত্র অর্থে ব্যবহৃত হয় না; সন্তানধারা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সন্তানই বংশধারাকে অবিচ্ছিন্ন বহমান করে এবং সুখপ্রদ করে তোলে।

চতুর্থ মন্ত্রে, মন থেকে দেবীকে আশীর্বাদ করে শরীরের রক্ষকরূপে শরীরে সর্বদা অবস্থান করতে প্রার্থনা জানানো হয়েছে। একই প্রার্থনা আমরা দেবীকবচেও দেখতে পাই। আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী জীবের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে বিরাজিতা হয়ে, সেইসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে রক্ষা করছেন। দেবীর আশীর্বাদেই দেহ কবচাবৃত হয়ে দুর্গতুল্য হয়ে যায়। তখন শরীরে কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না।

পঞ্চম মন্ত্রে, পরসেনাজয়ী, শত্রুগণের অভিভবকারী অগ্নিরূপা দেবীকে আহ্বান করে সব বিপদাপদ দূর করতে প্রার্থনা জানানো হয়েছে। যারা দেবীর শরণাগত হন, অগ্নিস্বরূপা দেবী জাজ্জ্বল্যমান অগ্নির মতো জীবের যাবতীয় সব মহাপাপ নিমেষেই বিনষ্ট করে দেন।

ষষ্ঠ মন্ত্রে, অগ্নিরূপা দেবীকে সদা স্তবযোগ্য হয়ে জীবের কর্ণদেশে অবস্থান এবং সৌভাগ্য প্রদানের প্রার্থনা করা হয়েছে। দুর্গাসূক্তের সপ্তম এবং শেষ মন্ত্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মন্ত্রে স্বর্গের উপরিভাগে নিবাসশীল সমস্ত দেবতা, ইন্দ্র, অগ্নি, বিষ্ণু এবং বিষ্ণুর বৈষ্ণবী শক্তি দেবীদুর্গা বিভিন্ন নামে অভিব্যক্ত পরমেশ্বরের রূপকেই একসাথে স্তোত্র করে প্রীতি বা ভক্তি বৃদ্ধির প্রার্থনা করা হয়েছে।

শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে অসুরাধিপতি শুম্ভ নিহত হলে, ইন্দ্রাদি দেবগণ দেবীর স্তুতি করেন। সেই স্তুতির নাম 'নারায়ণীস্তুতি'। সেই নারায়ণীস্তুতিও দেবীকে বিশ্বের আদিকারণ, অনন্তবীর্যা বিষ্ণুর জগৎপালিনী বৈষ্ণবী শক্তি নামে অভিহিত করা হয়েছে।

‘ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরনস্তবীর্যা

বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া।

সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ

ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তিহেতুঃ॥’

(শ্রীশ্রীচণ্ডী : ১১.৫)

‘হে দেবী, আপনি অনন্তবীর্যা বৈষ্ণবী শক্তি; বিষ্ণুর জগৎপালিনী শক্তি। আপনি বিশ্বের আদিকারণ মহামায়া আপনি সমগ্র জগৎকে মোহগ্রস্ত করেন, আবার আপনিই প্রসন্না হলে ইহলোকে শরণাগত ভক্তের মুক্তির কারণ হয়ে থাকেন।’

শঙ্খচক্রগদাশাঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে।

প্রসীদ বৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোঽস্তু তে৷৷

(শ্রীশ্রীচণ্ডী : ১১.১৬)

‘হে দেবী, আপনি বিষ্ণুশক্তিরূপে চারহাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গ (ধনু বা খড়্গ) এই চার মহাস্ত্র ধারণ করেন। হে নারায়ণি, আপনি প্রসন্না হোন। আপনাকে প্রণাম।’

শ্রীচণ্ডীর সপ্তস্থানে (৮.১৮, ৮.৩৪, ৮.৪৭, ৮.৪৮; ৯.৪০; ১১.৫, ১১.১৬) বিশ্বের আদিকারণ, অনন্তবীর্যা বিষ্ণুর জগৎপালিনী বৈষ্ণবী শক্তির কথা পাওয়া যায়।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়