ছবি : সংগৃহীত

দেশের জনগণ তাদের অর্থসম্পদ বিশ্বাস করে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত রাখে। কেউবা করে সঞ্চয়। জনগণের জমানো এসব অর্থসম্পদ দিয়ে ঋণ দেয় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে টাকা ঋণ দেওয়া হয় তা ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালকদের পকেট থেকে দেন না। ব্যাংকের অর্থের মালিকানা ব্যাংকের কোনো কর্তা-ব্যক্তির নয়।

তবুও ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পান প্রভাবশালী ব্যক্তি-ব্যবসায়ীরা। যে যত বড় তার ঋণ পাওয়ার পরিমাণও তত বেশি। ব্যাংক ঋণ দেবে, ব্যবসা করবে এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যে অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে তা বিশ্বে যেন নজিরবিহীন!

আমরা দেখতে পাই, নানা ধরনের ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক; বরং দিন দিন তা বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে মূলধন ঘাটতি। ঋণ চাহিদা কমার পরও প্রতিদিন কিছু ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং মুদ্রাবাজার থেকে বড় অঙ্কের ধার করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। কেবল এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থাৎ এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা।

২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে ৩৫ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। আর ১ বছরে (জুন-২০২২ থেকে জুন-২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যদিও আর্থিকখাত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি-সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। 

নানা ধরনের ছাড় দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক; বরং দিন দিন তা বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে রেকর্ড...

ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র যেন আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য বলছে, জুন শেষে নন ব্যাংকিং ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ দশমিক ২ শতাংশ বেশি (৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা)।

২০২৩ সালের জুন শেষে এই খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালের ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি রেড জোনে ছিল, যা ২০২১ সালের ১২টির চেয়ে বেশি। নন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকের মতোই। বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্স নিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানগুলো। একইভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের ঋণও দেয়।

এর আগে পিপলস লিজিং এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নাম সর্বস্ব কোম্পানির নামে ঋণ আবেদন করা হয়। মূলত আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই এসব ঋণ নেওয়া হয়। পরে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেওয়া হয় না। আবার কেউ কেউ কয়েক কিস্তি দিয়ে আর ঋণ পরিশোধ করেন না। মনে আসতে পারে, এভাবে কি সম্ভব? অসম্ভবকে সম্ভব করছে একটি লুটেরা গোষ্ঠী।

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের বেশকিছু তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে, আত্মসাতের উদ্দেশ্যে যেসব ঋণ নেওয়া হয় তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন। ঋণ নেওয়ার জন্য একটি প্যাড বানানো হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের নামে একটি ট্রেড লাইসেন্স করা হয়। তারপর সেই প্যাডে আবেদন করা হয় ঋণের জন্য। এভাবে ভুয়া প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা বের করে নেওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। 

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের বেশকিছু তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে, আত্মসাতের উদ্দেশ্যে যেসব ঋণ নেওয়া হয় তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বহীন।

ঋণ নেওয়ার জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা লেখা হয়েছিল দেখা গেছে, সেইগুলোর কোনো কোনোটির ঠিকানাই ঠিক ছিল না। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না থাকলেও কেবল সাইনবোর্ড ঝুলানো ছিল। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজশে ঋণের নামে এসব টাকা বের করে নেয় একটি চক্র।

এমন ঘটনায় যে একেবারেই তদন্ত কিংবা শাস্তি হচ্ছে না তা নয়। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কেউ কেউ ধরা খেয়ে জেলেও আছেন। অনেকক্ষেত্রে মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।

এর আগে ভারতের কারাগারে থাকা দুদকের মামলার আসামি পিকে হালদার পশ্চিমবঙ্গে আর্থিক গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, অর্থ আত্মসাৎ এবং পাচারে কেবল তার নাম বলা হলেও নেপথ্যে আর্থিকখাতের একটি প্রভাবশালী পক্ষ ছিল। দুদকের ৩৭টি মামলার এই আসামি আরও জানিয়েছেন, ঋণের নামে আত্মসাৎ হওয়া অর্থের সুবিধাভোগী কেবল তিনি নন।

এ তো গেল ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিকখাতের কথা! ব্যাংকিং খাতেও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। আবার অস্তিত্ব আছে এমন অনেক বড় অনেক প্রতিষ্ঠানও ঋণ দিয়ে টাকা গায়েব করার বহু নজির রয়েছে। ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে বাদশাহি জীবন যাপনও করছেন কেউ কেউ। এসব নিছক গল্প নয়!

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সাসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুদক এবং সিআইডি’র তদন্তেও ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির অনেক চিত্র বেরিয়ে এসেছে। খেলাপি হিসেবে এসব ঋণ দেখানো হলেও আদতে এর উল্লেখযোগ্য অংশই লোপাট।

সর্বশেষ টাকার অঙ্কটা আবার পুনরাবৃত্তি করি, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি অর্থাৎ আদায় হচ্ছে না ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা । আর নন ব্যাংকই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ১৯ হাজার ৯৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। যোগফল কত দাঁড়ায় দেখুন। দেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এই টাকায় করা সম্ভব। যদি এই অর্থ আদায় হতো সরকারেরও ধার দেনা কমে যেত। মজবুত ভিত্তি হতো অর্থনীতির। কিন্তু লুটেরা গোষ্ঠী কি বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সেই শক্তির জায়গায় নিয়ে যেতে দেবে?

আদিত্য আরাফাত ।। বিশেষ প্রতিনিধি, ডিবিসি নিউজ