যেদিন বিশ্বকাপ স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল বাংলাদেশের
স্বপ্ন সত্যি হওয়ার সে মাহেন্দ্রক্ষণে/ছবি: সংগৃহীত
‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ চিৎকারটা খুব পরিচিত। আপনি এই দেশের মানুষ হলে আরও বেশি। ক্রিকেট কিংবা এই সংশ্লিষ্ট হলে আরেকটু। আকবর আলি কতবার শুনেছেন এই স্লোগান? এমন প্রশ্ন একেবারেই অমূলক। হিসেবে খুব পাকা কেউও দিতে পারবেন না এর জবাব।
তবে যদি আকবর আলিকে জিজ্ঞেস করা যায়, সবচেয়ে মধুর করে ‘বাংলাদেশ’ স্লোগানটা কবে শুনেছেন। সেটার জবাব হয়তো দিতে পারবেন তিনি। তার দলের সবাইও। আপনি যদি ওই দিন বিমানবন্দর থেকে শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের পথে উপস্থিত থাকেন, হয়তো আপনার কাছেও উত্তরটা সহজ।
বিজ্ঞাপন
আকবর এখনো জাতীয় দলে খেলেননি, ধারেকাছেও নেই আপাতত। তবুও আকবরের একটা ‘দল’ আছে। খুব পরিচিত। তার বিশ্বকাপজয়ী দল। অদ্বিতীয় না হোক, তারা প্রথম হয়ে থাকবে সবসময়। আকবরের দলটা তাই আলাদা, অন্যরকম। ভালো লাগার কিংবা আপনার স্বপ্ন পূরণের দল।
চ্যাম্পিয়ন লেখা বাস। বিশ্বকাপ হাতে কিছু তরুণের উদযাপনের ছবি লাগানো পুরোটায়। নামছেন ১৯ না পেরোনো কিছু তরুণ। চারপাশে তাদের নামে চিৎকার। ‘বাংলাদেশ’ বলার তৃপ্তির সবটুকু কেড়ে নেওয়ার লড়াই। লাল-সবুজ পতাকার ছড়াছড়ি। ঢোল, বাদ্য, তবলা আছে সবই। সামনে লাল গালিচা। চারপাশে মানুষের স্রোত। ফুলের উড়াউড়ি। তাদের সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটেছে। আকবররা প্রত্যাশা ছাপিয়ে নিয়ে গেছেন এক রূপকথার রাজ্যে, তাদের বরণ করার আকাঙ্ক্ষা হৃদয়জুড়ে। সাধারণত অসময় বলতে খারাপ সময় বুঝায়। এই সময় আনন্দের, আগে আগেই নিজের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখানোর।
বিজ্ঞাপন
আরও বছর দশেক কিংবা তার আরেকটু আগে-পরে। টিভি এসেছে তখন। সাদা কালোই বেশি, মাঝে মাঝে কারো ঘরে রঙিন। বোকা বাক্স ঘিরে আছে প্রতীক্ষাও। শুক্রবারের বাংলা সিনেমা অথবা সন্ধ্যা নেমে এলে আলিফ লায়লা। দেখার আছে আরও অনেক কিছু। চারদিক মিলিয়ে ১৪ ইঞ্চির একটা টেলিভিশন, সেটাই সম্বল ওই মফস্বলের।
আধুনিকতার ছোঁয়া একটু-আধটু লাগা, অসংখ্য আনন্দের কাজের সুযোগ যেখানে। সেখানেও এক দল টিভি পর্দায় চোখ রাখেন। বাংলা সিনেমা কিংবা আলিফ লায়লার জন্য না। ক্রিকেট, একটু খানি ব্যাট-বলের লড়াই উপভোগ দরকার তাদের। ওই ১৪ ইঞ্চির রঙিন অথবা সাদাকালো পর্দাটা কাছের মনে হয় খুব। সন্দেহ কিংবা সংশয় জাগে আদৌ এসব বাস্তব কিনা। তবে দূরের এক কল্পনাও ভেসে ভেড়ায় সঙ্গে। চার, ছক্কা, স্টাম্প ভাঙাকে পাশ কাটিয়ে।
একবার বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দ ভাসার। যে দলটা গুঁটিয়ে যায় আটান্নতে, আটাত্তরে, টেস্ট জেতা হয় না, ওয়ানডেতে জয় কালেভদ্রে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট-সংস্কৃতি ঠিকঠাক নেই। চারপাশে ধুয়োধ্বনি। প্রায় প্রশ্ন উঠে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে। সেই দেশ বিশ্বকাপ জিতবে, এ যেন কল্পনারও বিলাসিতা। আকবররা সেটা মানেন না। আগে অনেকে চেষ্টা করেছেন। তাদের পূর্বসূরী মেহেদী হাসান মিরাজরা থেমেছেন ঘরের মাঠে শেষ চারে।
আকবরা সেটা পার করেছেন। নেমেছেন শিরোপা জয়ের মঞ্চে, ভারতের বিপক্ষে। হ্যাঁ, ভারতের। যাদের কাছে এসে স্তিমিত হয়ে যায় স্বপ্নের ছুঁটেচলা। হবে হবে করেও হয় না। জাতীয় দল হোক কিংবা বয়সভিত্তিক পর্যায়ের ক্রিকেট, নিদাহাস ট্রফি, এশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসর অথবা বিশ্বকাপ, ফলটা একই। শঙ্কার মেঘে তাই ঘিরে ফেলে চারপাশ। আদৌ হবে তো?
———————
পচেফস্ট্রুম, দক্ষিণ আফ্রিকা, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
এনকোলার বল করলেন রাকিবুলকে। তিনি সেটা ঠেলে দিলেন ডিপ মিড উইকেটে। রাকিবুল দৌড় দিলেন, আকবরও। এক রান। দৌড় দিলেন আর কে কে? শরিফুল, পারভেজ, সাকিব, তামিম সবাই। পচেফস্ট্রুম আজ তাদের। তাদের আজ পুরো বিশ্ব।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জিতেছে। ভারতকে হারিয়ে। আকবর আলি শিরোপাটা উঁচিয়ে ধরলেন। তার একা একটা ছবি ট্রফি হাতে, তার কীর্তির বিশালত্ব বুঝাতে বোধ হয় ব্যাকগ্রাউন্ডে শুধু আকাশটাকে রাখলেন। আরও একটা বা অনেকগুলো ছবি দলের। সেসব ঠাঁই করে নিলো বাংলাদেশ কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে।
ইয়ান বিশপ কমেন্ট্রিতে, তিনি ভরাট গলায় বলে উঠলেন, ‘বাংলাদেশ হ্যাভ ডান ইট। দে উইল বি ডান্সিং ইন দ্য স্ট্রিট অফ ঢাকা, সিলেট, চিটাগাং... ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক! আকবার আলী হ্যাজ সিন ইট টু দ্য এন্ড। বাংলাদেশ আর দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন...অফ দি আন্ডার নাইন্টিন।’
———————
ঢাকা, বাংলাদেশ, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০
রাস্তাঘাট তখন নিশ্চুপ হয়ে আসার পথে। সড়কবাতির আলো কমে এসেছে। কমছে সড়কের ব্যস্ততাও। রাত দশটা কিংবা তার আরেকটু বেশি। হঠাৎ কেমন ঝিমিয়ে যাওয়া শহর উল্লাসে ফেরে। ক্রিকেট অথবা আকবর আলিদের কারণে।
আপনি হয়তো তখন ব্যস্ততা শেষে ঘুমানোর অপেক্ষায় ইট পাথরের শহরের কোনো এক কোণে। আপনার ঘুম হঠাৎ চলে গেছে। আপনি চোখ মুছতে শুরু করতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। অনিদ্রা রোগে ধরে একটা রাত আপনি না ঘুমিয়েও কাটিয়ে দিতে পারেন। আপনার দেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে।
অথবা আপনি থাকেন মফস্বলে। আপনার গ্রাম বদলে গেছে কুড়ি বছরে। সাদাকালো টিভি রঙিন হয়েছে, বিদ্যুতের অভাবে রেডিও নিয়েও ঘুরে বেড়াতে হয় না আর। তবে আপনার স্বপ্নটা ছিল, মুখে মুখে হয়তো বলতেন, ‘আমাদের ছেলেরাও বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ জিততে দেখবে না।’
কিন্তু আপনি মনে প্রাণে চাইতেন বিশ্বকাপ জিততে। বাংলাদেশের বিশ্বজয় দেখতে চাইতেন নিজ চোখে। আপনি যখন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন আপনার দেশ জিতে গেছে বিশ্বকাপ, তখন আপনার কী অনুভূতি হয়েছিল? যেটাই হোক, আজ তার এক বছর হয়ে গেল। ৩৬৫ দিন। অনুভূতি কি এখনো একই আছে? সারাজীবনও নিশ্চয়ই থাকবে?
এমএইচ/এটি/এনইউ