আর্থার মরিস : ‘যাকে অনুসরণ করা সম্ভব না’
যাকে অনুসরণ করা যায় না, তিনি ব্যাট হাতে....
নায়ককে চেনা যায় সহজে। চলনে, বলনে কিংবা গল্পের প্রয়োজনে। হাবেভাবে, কখনো মূখ্য চরিত্র হয়ে ওঠাতে নায়ককে আলাদা করে ফেলা যায় বেগ পাওয়া ছাড়াই। তবুও পাশে থেকে উঠে আসেন কেউ কেউ।
নায়ককে ছাপিয়ে যান, নিজেকে কেবল চেনান না, আলাদা করে ফেলেন। ‘তক্বদীর’ ওয়েব সিরিজে মন্টু যেমন। অথবা ডন ব্র্যাডম্যানের বিখ্যাত ‘দ্য ইনভেন্সেবল’ দলের আর্থার মরিস। নায়ক ব্র্যাডম্যানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন যিনি।
বিজ্ঞাপন
***
বৈচিত্র্য, দাপট আর ধ্বংসাত্মক। জীবনজুড়ে আর্থার ছিলেন এমন। বোলারদের পিটিয়েছেন, ধৈর্য্য ধরে থেকে গেছেন ক্রিজেও। তাতে হয়ে ওঠেছেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরাদের একজন; অন্তত ওপেনার হিসেবে।
বিজ্ঞাপন
আর্থারের শুরুর গল্পটা রোমাঞ্চকর, ঠিক পুরো জীবনের মতো। যে ব্যাটিং দিয়ে তিনি নিজেকে চিনিয়েছেন, সে ব্যাটটাই শুরুতে ছিল না তার। খেলতেন ধার করা ব্যাট দিয়ে। করতেন স্পিন বোলিং।
সিডনির বন্ডি নামক এক উপকূলীয় শহরে জন্ম। বয়স যখন চার বছর হলো, ততদিনে বাবা আর তাকে ছেড়ে চলে গেছেন ইংরেজ মা। এরপর শিক্ষক বাবার সঙ্গে শহরে চলে এলেন। শৈশবেই সঙ্গী হলো এক মানসিক বিপর্যয়, বড় হতে থাকলেন একা বাবার সঙ্গে।
সিডনিতে ভর্তি হলেন সেন্টারবোরি হাই স্কুলে। সেখানে খেলতেন রাগবি আর টেনিসও। মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুযোগ পেয়ে যান সেন্ট জর্জের হয়ে ক্রিকেট খেলার। স্পিনার হিসেবে পেয়েছিলেন ৫৫ উইকেট।
তবুও সেন্ট জর্জের লেগ স্পিন কিংবদন্তি ব্লুফ বিলের কাছে আর্থারের বোলিংকে ‘শিশুসুলভ’ মনে হয়েছিল। তিনি বদলে যেতে বলছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন ব্যাটসম্যান হওয়ার। আর্থার সেটা গ্রহন করেন, বনে যান ওপেনার।
ফলাফলটাও পান হাতে হাতে। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর, আর্থারের বয়স তখন সবে আঠারো। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে অভিষেক হয় আর্থারের, কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে। তিনি সেখানে নিজেকে চেনান অন্যভাবে কিংবা চেনানোর শুরু করেন সেখান থেকে। দুই ইনিংসে করেন ১৪৮ এবং ১১১ রান।
একটা প্রথমেও তাতে নাম ওঠে যায় আর্থারের। তার আগে কেউ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের অভিষেকে সেঞ্চুরি করতে পারেননি। এমন একটা কীর্তি আর্থার গড়েছিলেন ধার করা ব্যাট দিয়ে। সেটা পৌঁছেছিল পরে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়া ডক ইভাটের কানে। তিনি আর্থারকে এরপর ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন।
***
এরপরই বিরতি পরে আর্থারের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে। নায়ক যারা হন, তাদের আরও কতকিছুই তো করতে হয়! আর্থার চলে গেলেন একেবারে যুদ্ধে। অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর হয়ে পাপুয়া নিউগিনিতে তিন বছর লড়েছেন। এরপর আবার ফিরে এসেছেন ব্যাট হাতেও।
১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে আবার ফিরে আসেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ফিরেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও। তবে আর্থার খেলছিলেন কেবল ‘মজা’র জন্য। সেটা নিজের প্রথম তিন ইনিংস পর্যন্ত। প্রথম দুই ইনিংসে দুই আর পাঁচ রানে আউট হলেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তৃতীয় ইনিংসে করলেন ২১ রান।
এরপরই ‘মজা’ শেষ হয়ে গেল আর্থারের। মজা দেখালেন ওয়ালি হ্যামন্ডসের ইংল্যান্ডকে। ছয় ঘণ্টা ক্রিজে থাকলেন, ধৈর্য্য, সংযম আর লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে খেললেন ১৫৫ রানের ইনিংস। যেটি ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিতে যথেষ্ট হলো।
আর্থার সবকিছু ছাপিয়ে গিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালের অ্যাশেজে। ক্যারিয়ারের সব ‘মজা’ তিনি বোধ হয় তুলে রেখেছিলেন এই সিরিজের জন্যে। পাঁচ ম্যাচের নয় ইনিংসে করেছিলেন ৬৯৬ রান। তার মধ্যে ছিল হেডিংলির সেই দুর্দান্ত ইনিংস। যে ম্যাচের শেষদিনে ৪০৪ রান করতে হতো অস্ট্রেলিয়াকে। ওই ম্যাচে ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে গড়েছিলেন ৩০১ রানের জুটি।
***
আপনি মরিসকে খলনায়কও বানিয়ে দিতে পারেন চাইলে। নায়ককে যিনি আটকে দেন তাকে তো তাই বলে! ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা কোনটি? এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে নিশ্চয়ই ব্র্যাডম্যানের শেষ ম্যাচে শূন্য আর ৯৯.৯৪ এ আটকে থাকা গড়ের কথা বলতে ভুলবেন না। আপনি তার দায় চাইলে তুলে দিতে পারেন মরিসের কাঁধে।
তার কারণেই তো অস্ট্রেলিয়াকে থামতে হয়েছে এক ইনিংস ব্যাট করে, ব্র্যাডম্যানের শেষ ম্যাচে। ব্র্যাডম্যানকে কিংবা পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে পুড়তে হয়েছে আজন্ম আক্ষেপে। প্রথম ইনিংসে ৫২ রানে থমকে গিয়েছিল ইংল্যান্ড, তার জবাব দিতে নেমে অজিদের পক্ষে আর্থার একাই করে ফেলেছিলেন ১৯৬ রান।
অস্ট্রেলিয়া তাতে করেছিল ৩৮৯ রান। ইংল্যান্ড দুই ইনিংস মিলিয়েও সেটা করতে পারেনি। তাই অস্ট্রেলিয়াকে নামতে হয়নি দ্বিতীয় ইনিংসে। শতক ছোঁয়া গড়ে শেষ হয়নি ব্র্যাডম্যানের ক্যারিয়ারও।
***
আর্থারের ক্যারিয়ারের মতো ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল উত্থান আর পতনের গল্প। ১৯৫৩ সালের অ্যাশেজ খেলার সময় ভিক্টোরিয়া প্লেসের এক থিয়েটারে গিয়েছিলেন। সেখানেই প্রেমে পড়েছিলেন ওই দলের সদস্য ভ্যালারি হডসন নামের এক সুন্দরী। এক বছরের মাথায় বিয়েও করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিন না যেতেই ক্যান্সার ধরা পড়ে আর্থারের স্ত্রীর। তিনি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ান টাকার জন্য। ততদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে ফেলেছেন। ১৯৫৬ অ্যাশেজ কাভার করতে গিয়েছিলেন ডেইলি এক্সপ্রেসের হয়ে, টাকা দরকার তার। টাকা হয়তো পেয়েছিলেন আর্থার। কিন্তু সেটা কাজে আসেনি। বিয়ের তিন বছর পর মারা যান ভ্যালারি।
এরপর প্রায় এগারো বছর একাকি জীবন কাটিয়েছেন। পরে গিয়ে বিয়ে করেছেন জুডিথ মেনমুয়ারকে। আমৃত্যু তার সঙ্গে জুড়ে ছিলেন। ভালোবেসেছেন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আর্থার নিজে পরপাড়ে গিয়েছিলেন ২০১৫ সালের ২২ আগষ্ট।
তার আগে জমা রেখে গেছেন অসংখ্য গল্প, গড়ে গেছেন অগণিত কীর্তি। ব্র্যাডম্যানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। এক বাক্যই বোধ হয় প্রমাণ করে অনেক কিছু। নায়ক অথবা পার্শ্বচরিত্র যে হিসেবেই থাকুন। আর্থার করে গেছেন এমন কিছু, যাতে তাকে ক্রিকেট ইতিহাসকে স্মরণ রাখতে হয় চিরদিন।
ব্র্যাডম্যান যাকে বলেছিলেন ‘আর্থার এমন এক প্রতিভা যাকে অনুকরণ করা সম্ভব নয় এবং কারও সে চেষ্টাও করা উচিৎ নয়। তাঁর ব্যাট ধরার ধরণটাই অস্বাভাবিক।’ তার জন্মদিন আজ। অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি। শুভ জন্মদিন এমন একজনকে, যাকে অনুসরণ করা যায় না।
এমএইচ