ছবি : সংগৃহীত

‘একুশের উচ্চারণ দূর হ দুঃশাসন’ এই শ্লোগান কোনো বিশেষ দেশ, সময়, সমাজ বা ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ করতে পারবেন না—উচ্চারণটা আমরা বাংলায় করছি বটে, কিন্তু কথাটা সর্বজনীন, ইংরেজিতে যাকে বলে ইউনিভার্সাল।

একুশ মানেই হচ্ছে দুঃশাসন বিতাড়ন। কেন? একুশে ফেব্রুয়ারি তো হচ্ছে ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার জন্যে রক্ত দেওয়া, এর সাথে দুঃশাসন ইত্যাদি আসে কী করে? সেটাই বলি ছোট করে। প্রথমে বলি দুঃশাসন মানে কি? তারপর একুশের সংগ্রাম, তাহলে উপসংহার এমনিতেই চলে আসবে।

দুঃশাসন মানে কী? মহাভারতে দুঃশাসন নামে একটা চরিত্র আছে, মন্দ চরিত্র, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র আর দুর্যোধনের ছোট ভাই। দুঃশাসনের যে চরিত্র সেটাই হচ্ছে দুঃশাসন, এর অর্থ—দুর্বিনীত, উদ্ধত, মূল্যবোধ বিবর্জিত, শুভ-অশুভ জ্ঞান রহিত ও সর্বোপরি যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যা শাসন করা যায় না। এটাই হচ্ছে দুঃশাসন।

আরও পড়ুন >>> নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন যায় 

কথাকে রাজনীতিতে ফেলেন, তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? রাজনৈতিকভাবে দুঃশাসন মানে হচ্ছে সেই শাসনব্যবস্থা যেটা জনগণের প্রতি দুর্বিনীত ও উদ্ধত, এবং অন্যসব বিশেষণ যেগুলো আগে বলেছি সেগুলো তো আছেই।

এরকম শাসনব্যবস্থা কি আমাদের ইতিহাসে আগে কখনো ছিল? হ্যাঁ, ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যে সরকার গঠন করেছিল তারপর লিয়াকত আলী খানের সময়ও সেই দুঃশাসন ছিল। এরপরেও ছিল, নানা সময়েই আমরা দুঃশাসন মোকাবিলা করেছি, কিন্তু একুশের প্রসঙ্গ বলে পাকিস্তানের সেই সময়ের সরকারের কথা বলছি। 

১৯৪৮ থেকেই আলোচনা চলছিল রাষ্ট্রভাষা কী হবে? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও এটা নিয়ে কথা হয়েছে। সকলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত কিন্তু জিন্নাহ হুট করে ঘোষণা করে দিল, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ওদের সরকারকে আমরা দুঃশাসন বলছি কেন? কারণ ওরা আমাদের মতামতের তোয়াক্কা করেনি, আমাদের সাথে আলাপ আলোচনা এইসবের প্রয়োজন মনে করেনি। ওরা ভাবতো যে ঐখানে বসে ওরা যা চাইবে তাই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেবে আর আমরা সেটা মেনে নিতে বাধ্য থাকবো। আর যদি মানতে না চাই তাহলে লাঠি মেরে বা গুলি করে মানতে বাধ্য করবে।

ওদের চোখে ওরা আমাদের দেখতো ছোট জাত, অপেক্ষাকৃত মন্দ মুসলমান বা আদৌ মুসলমান নই বা হিন্দু এইরকমভাবে। দুর্বিনীত ও উদ্ধত। ভাষার প্রশ্নটা দেখেন, গণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত হতে কোনো অসুবিধা ছিল না।

আরও পড়ুন >>> বাংলালিপি : উৎস ও বিবর্তন 

১৯৪৮ থেকেই আলোচনা চলছিল রাষ্ট্রভাষা কী হবে? পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও এটা নিয়ে কথা হয়েছে। সকলে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত কিন্তু জিন্নাহ হুট করে ঘোষণা করে দিল, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। দুর্বিনীত আচরণ। ওদের কথা হচ্ছে ওরা নাকি আমাদের চেয়ে ভালো বুঝবে।

সিদ্ধান্ত তো চূড়ান্ত বিচারে গণতান্ত্রিক পথেই হয়, কিন্তু দুর্বিনীত ঐসব শক্তি গণতন্ত্রের পথে আনতে হলে সংগ্রাম করতে হয়—সংগ্রাম হয় দুঃশাসন দূর করার সংগ্রাম। একুশের সংগ্রামও ছিল ঐটাই—দুঃশাসন হঠানোর সংগ্রাম।

আমরা সবাই জানি, ভাষা আন্দোলনই আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত করেছে আর সেই পথ ধরেই আমরা বাঙালির জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। শাসকের ঔদ্ধত্য আমাদের জাত্যভিমান আঘাত করেছিল বলেই বাঙালি জাগ্রত হয়েছিল। চেতনা কী ছিল?

আমরা সবাই জানি, ভাষা আন্দোলনই আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত করেছে আর সেই পথ ধরেই আমরা বাঙালির জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি...

বাংলা আমাদের ভাষা, আমরা বাঙালি। অন্য কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বেষ থেকে নয় বা অন্য কোনো জাতিসত্তা ছোট করার ইচ্ছা প্রবণতা বা আকাঙ্ক্ষা আমাদের মূল চেতনা ছিল না—ছিল আমাদের নিজের জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত করা।

বাংলা ভাষা ছিল আমাদের বাঙালি পরিচয়ের প্রকাশ—আমরা সেটাই প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছি ১৯৫২-তে আর সেই চেতনা থেকেই পরবর্তীতে শ্লোগান এসেছে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি। অর্থাৎ ভাষার হাত ধরে জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা এবং সেখান থেকেই ভৌগোলিক পরিচয়।

আরও পড়ুন >>> রাষ্ট্রভাষা: বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? 

ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছি, আমাদের নিজেদের জন্য আমরা রাষ্ট্র স্থাপন করেছি। তার জন্য কি এখন ১৯৫২ কেবল একটি ইতিহাস হয়ে গেছে? বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে? না। ঐ শিক্ষায় রয়ে গেছে—মূল চেতনা। সেটা কী? সেটা হচ্ছে আমরা বাঙালিরা আমাদের প্রতি কোনোপ্রকার ঔদ্ধত্য ও দুর্বিনীত আচরণ সহ্য করবে না।

শাসকের ঔদ্ধত্য বা দুঃশাসন আমাদের যুগে যুগে ক্রুদ্ধ করেছে। কারণ একুশের চেতনা আমাদের শরীরে প্রবাহিত হয়। আমরা দুঃশাসন মানবো না, দুঃশাসন আমরা রাখি না।

ত্যাগ করতে করতে ত্যাগ স্বীকার করবো, রক্ত দিতে হয় রক্ত দেব—কিন্তু দুঃশাসন বাঙালি রাখবে না। এটাই হচ্ছে একুশের অন্তর্নিহিত উচ্চারণ—দূর হ দুঃশাসন।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট